জনগণের সারা দিনের কথাবার্তার মধ্যে যে বিষয়গুলো থাকে তাহলো- বাজার সিন্ডিকেট, হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়া, আদালতে বিচার না পাওয়া, তহশিল অফিসে গিয়ে হয়রানির শিকার হওয়া, জন্মনিবন্ধন পেতে হয়রানির শিকার হওয়া, থানায় গিয়ে পুলিশের সহযোগিতা না পাওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবাণিজ্য ইত্যাদি। সেই সঙ্গে তারা উন্নত বিশ্বের নাগরিক সুবিধার উদাহরণও দেন। অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে সবার মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। তারা আরও জেনেছেন যে গণতন্ত্রের মধ্যে সব মতাবলম্বী মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু ফিক্সড মতাদর্শকেন্দ্রিক রাষ্ট্রে কথা বলা ও চলাফেরার স্বাধীনতা না-ও থাকতে পারে। যেমন- চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের শাসনব্যবস্থা উদাহরণ হতে পারে। সে কারণে কোনো দলই গণতন্ত্র শব্দটি বাদ দিতে পারছে না। নতুন প্রজন্মও গণতন্ত্র ব্যতিরেকে অন্য কোনো মতবাদে আটকে থাকতে চাচ্ছে না। এ দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থার পেছনে রয়েছে গণতন্ত্র না থাকা। মজার বিষয় হলো- স্বৈরশাসকরা নিজ দেশে গণতন্ত্র বাস্তবায়ন না করলেও পতনের পর ইউরোপ-আমেরিকায় আশ্রয় নেন। গণতন্ত্রে গোপন বলতে কিছু নেই। বিগত সরকার এমন কিছু আইন করে যা গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৬। এ আইনে কেউ যদি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেয়, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১ কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে। এ আইনের কারণে পত্রিকায় কেউ কার্টুন আঁকতে সাহস পাননি। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নিলে শাসককেই চরম বিপদে পড়তে হয়। শাসকের কাছে বহু তথ্য অজানা থাকে। যেমন- বিগত সরকারের সময় সালমান এফ রহমান, বেনজীর আহমেদ, মতিউর রহমান, জেনারেল আজিজ, মোশাররফ হোসেন, শাহেদ আলী, পি কে হালদার, আছাদুজ্জামান মিয়া, ওসি প্রদীপ, ড্রাইভার আবেদ আলী, ড্রাইভার মালেক, পানি জাহাঙ্গীরসহ শতাধিক ব্যক্তি তো মাত্র এক বছর যাবৎ দুর্নীতি শুরু করেননি। তাঁরা দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর আগে থেকেই দুর্নীতি করে আসছেন। তাঁদের সহকর্মী, অধস্তন কর্মকর্তাসহ বহু ব্যক্তি তাঁদের দুর্নীতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কিন্তু বিপদে পড়ার ভয়ে কেউই মুখ খোলেননি। ২০২৪ সালের জুন-জুলাই মাসে সরকারবিরোধী আন্দোলন চরমে উঠলে তাঁরা একসঙ্গে তাঁদের দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করতে থাকেন। ফলে সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়ে পড়ে। আশার কথা- আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবাই একমত হয়েছেন যে ফ্যাসিবাদী শাসনের মূলে রয়েছে শাসনগত ত্রুটি। সেজন্য বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করেছে। যদিও আমরা দীর্ঘ বছর যাবৎ বলে আসছি- রাষ্ট্রের ২৮টি ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন করা হলে সর্বস্তরে গণতন্ত্র বাস্তবায়ন হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি মডেল রাষ্ট্রে পরিণত হবে। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সর্বস্তরে অনুশীলন হতে থাকবে। তবে ‘সংস্কার’ শব্দটি পুরনো ব্যবস্থাকে মেরামত- বোঝায়। এখানে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা উদাহরণ হতে পারে। আমরা জানি, বিদ্যমান স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। এ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা মানে ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা। সেজন্য ‘স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করতে হবে’- বাক্যটি যথাযথ। কারণ গণতন্ত্রের মধ্যে স্বাবলম্বন, শক্তিশালীকরণসহ বহু কিছু রয়েছে। তা ছাড়া রচনার শিরোনাম বলে দেয় কী লিখতে হবে। সে কারণে কমিশনগুলোর নাম হওয়া উচিত- ১. পুলিশ প্রশাসন গণতান্ত্রিককরণ; ২. বিচার বিভাগ গণতান্ত্রিককরণ; ৩. দুর্নীতি বিভাগ গণতান্ত্রিককরণ; ৪. জনপ্রশাসন বিভাগ গণতান্ত্রিককরণ; ৫. সংবিধান গণতান্ত্রিককরণ; ৬). নির্বাচনব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ৭. গণমাধ্যম গণতান্ত্রিককরণ; ৮. স্বাস্থ্যব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ৯. শ্রমব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ১০. নারীবিষয়ক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ১১. স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ। আরও হতে পারে ১২. বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ১৩. শিক্ষাব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ১৪. ঔষধ নীতি গণতান্ত্রিককরণ; ১৫. সড়ক, রেল, নৌপথ ও বিমানব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ১৬. ভূমিব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ১৭. পানিব্যবস্থাপনা গণতান্ত্রিককরণ; ১৮). পর্যটনব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ১৯. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনাব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ২০. পারিবারিক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ; ২১. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি গণতান্ত্রিককরণ; ২২. শিল্পব্যবস্থা গণতান্ত্রিককরণ ইত্যাদি। সরকার এগুলো গণতান্ত্রিক করার জন্য বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, বিভিন্ন দল, বুদ্ধিজীবী, জনপ্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও নাগরিকদের সঙ্গে গণশুনানির ব্যবস্থা করতে পারেন এবং তাদের কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব নিতে পারেন। তাহলে এগুলো জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হবে এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এগুলো বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হবে। গণশুনানির সুবিধা হলো জনগণের বহু অজানা তথ্য জানা যায়। যেমন- এমন কোনো বিক্রেতা নেই যিনি হাটে-বাজারে তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে ইজারাদার ও তার লালিত বাহিনীর কাছে অপমানিত হননি। একইভাবে গরু-ছাগল ক্রয় করতে গিয়ে ক্রেতাও অপমানিত হন। বিদেশে গিয়ে শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স আনছে; অথচ বিমানবন্দরে তারা যথাযথ সম্মান পান না। সেজন্য বর্তমান সরকার বিমানবন্দরে তাদের জন্য পৃথক কক্ষের ব্যবস্থা করেছেন। তেমনি উৎপাদক শ্রেণির সম্মানার্থে টোলপ্রথা বিলুপ্ত হওয়া উচিত। শোনা যাচ্ছে, স্থানীয় সরকারে পার্লামেন্ট পদ্ধতি চালু হবে।
এ দেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায় মানুষের সংকীর্ণতা দূর হয়নি। তারা সামান্য ঘটনায় আঞ্চলিকতা ও আত্মীয়তাকে সামনে নিয়ে আসে। সে কারণে আইয়ুব খানের আমলে বেসিক ডেমোক্র্যাসির সময় এ ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। নির্বাচনের আগের দিন বিরোধী মেম্বারকে আটক করে রাখার ঘটনা মানুষ এখনো ভুলে যায়নি। এ দেশে চেয়ারম্যান ও মেয়র পদটির একটি ঐতিহ্য রয়েছে। চেয়ারম্যান ও মেয়রদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানোর জন্যই ব্যবস্থাটি গণতান্ত্রিক করতে হবে। আমাদের জানা রয়েছে যে তারা যেসব বিষয়ে সংস্কার চাচ্ছেন সেগুলো বহু আগে বহু রাজনৈতিক দল, সংগঠন, গবেষক, বুদ্ধিজীবীরা দিয়ে রেখেছেন। আমাদের আরও জানা রয়েছে, যারা সংস্কার কমিশনে আছেন তাদের অনেকেই ২০০৬ সালের এক-এগারোর সময় ও সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারের সময় শত শত সেমিনার করেছিলেন এবং একই রকম সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কেউ কেউ সংস্কার কমিশনের সদস্যও হয়েছিলেন; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিএনপির নেতারা বলা শুরু করেছেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন এবং তাঁরা ইতোমধ্যে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবও দিয়েছেন। তাঁরা বারবার বলছেন, রাষ্ট্র সংস্কার করার দাবি যৌক্তিক। একই সঙ্গে এ কথাও বলছেন, সংস্কার করার দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর বড়ই দুর্ভাগ্য যে তাদের কাজ তারা করেনি বলে এখন অনির্বাচিত সরকারের কাছে আশা করতে হচ্ছে।
লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক