বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শিকভাবে প্রবল প্রতিপক্ষ দুটি দল আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী। এ দুটি দলের বিবাদ কেবল যে আদর্শিক তা নয়, রাজনৈতিক বিবাদও যথেষ্ট। আমরা যদি দূর ও কাছের অতীতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিব ও তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মুসলিম বাঙালি নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়ে ভারত ভেঙে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি ‘পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়েছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রবল জোয়ার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষিত ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে ভারতের কোথাও রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার ঘটনা না ঘটলেও কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত হয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণীতে কলকাতায় চার দিনব্যাপী দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৪ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে। ভারতে ব্রিটিশ সরকার এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দাঙ্গার পেছনে প্ররোচনা দানকারী হিসেবে বাংলার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে এককভাবে দায়ী করে। এজন্য বাঙালি হিন্দুরা ছেচল্লিশের দাঙ্গার ইতিহাস স্মরণ করে সোহরাওয়ার্দীকে এখনো ‘বাংলার কসাই’ হিসেবেই জানে। তিনি দাঙ্গার উসকানিদাতা হয়ে থাকলে তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা যে হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি তা নিশ্চিত বলা যায়।
অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবসহ তাঁর অন্য শিষ্যরা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ মন্ত্রে অতিমাত্রায় দীক্ষিত ছিলেন এবং পণ করেছিলেন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধানোর মতো নৈরাজ্য সৃষ্টি করে হলেও মুসলমানদের জন্য ‘স্বাধীন পাকিস্তান’ হাসিল না করে ঘরে ফিরবেন না। তারা পাকিস্তান আদায়ে সক্ষম হয়েছিলেন। অচিরেই তাদের মোহভঙ্গ হয়েছিল। তারা পাকিস্তানের দাবি বাস্তবায়নকারী দল মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীভূত শাসনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন। তারা মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নতুন দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ বিপুলভাবে বিজয় লাভ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একক কৃতিত্বের অধিকারী মুসলিম লীগের নামনিশানা পূর্ব পাকিস্তান থেকে কার্যত মুছে যায়। আওয়ামী মুসলিম লীগ তাদের দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটিকে বিদায় দেয় এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় মূলত হিন্দু ভোটারদের সমর্থন আদায় করতে।
গণতন্ত্রের মানসপুত্র খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালে বৈরুতের একটি হোটেলে মারা যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অধিকতর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবিকে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে নেন, যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয় এবং ১৯৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পূর্ববঙ্গের যেসব বাঙালি মুসলিম পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে শরিক ছিলেন, নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাদের একটি বড় অংশ তাদেরই অর্জন করা অখণ্ড পাকিস্তানকে ভাঙায় নেতৃত্ব দান করেন।
অপরদিকে ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ অধিবেশনে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ গৃহীত হওয়ার পর থেকে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো সমন্বয়ে তাদের পৃথক আবাসভূমি ‘পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ১৯৪১ সালে সাইয়িদ আবুল আলা মওদুদীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ ভারত বিভাজন প্রতিহত করার লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। তিনি ভারতের বুক চিড়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্যে মুসলমানদের কোনো কল্যাণ দেখতে পাননি। ১৯৪১ সালে সাইয়িদ আবুল আলা মওদুদীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ ভারতের কোনো ধরনের বিভক্তি প্রতিহত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, মুসলিম পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, এটা কোনো ইসলামি আন্দোলন নয়। কারণ পাকিস্তানের ধারণা ইসলামের ‘উম্মাহ’র ধারণার পরিপন্থি। তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে তিনি পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের কঠোর সমালোচনা শুরু করেন। বিশিষ্ট রাজনৈতিক ইতিহাবিদ মহিউদ্দিন আহমদ গত আগস্ট ২০২৪-এ প্রকাশিত তাঁর ‘জামায়াতে ইসলামী : উত্থান বিপর্যয় পুনরুত্থান’ শীর্ষক গ্রন্থে মওদুদীর ভাষণ, তাঁর বিভিন্ন নিবন্ধ থেকে যেসব উদ্ধৃতি দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, তিনি ১৯৪৩ সালে পাকিস্তানকে ‘আহম্মকের বেহেশত’ এবং ‘মুসলমানদের কাফেরানা রাষ্ট্র’ অভিহিত করেছেন। পাকিস্তান প্রস্তাব তাঁর হৃদয়ে দুঃখ ও মাতম সৃষ্টি করেছিল। মুসলিম লীগ সম্পর্কে তিনি বলেছেন যে, ‘ওরা আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ; ওরা পরিবেশকে শৌচাগারের চেয়েও নোংরা করে ফেলেছে। এটি বাজিকরের একটি দল।’ জিন্নাহ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিল- “এই ব্যক্তির ত্রুটি বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। লীগের কায়দে আজম থেকে শুরু করে কেউই ‘মুসলিম’ শব্দের অর্থ পর্যন্ত জানে না।” মোদ্দা কথা হলো, মাওলানা মওদুদী ভারত বিভাগকে একটি নতুন ভৌগোলিক সীমান্ত সৃষ্টি হিসেবে দেখেছিলেন, যা মুসলমানদের একজনকে আরেকজনের কাছ থেকে বিভক্ত করবে। মাওলানা মওদুদী ও জামায়াতে ইসলামী ভারত বিভক্তির প্রবল বিরোধিতা করা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি তাঁর অপছন্দনীয় পাকিস্তানকেই জামায়াতের কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্রে পরিণত করেন। পাকিস্তান আনয়নকারী দল মুসলিম লীগ যখন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সব কটি প্রদেশে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল এবং নতুন জনপ্রিয় দলের অভ্যুদয়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা হুমকির মধ্যে পড়েছিল, তখন জামায়াতে ইসলামী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে তুলনামূলকভাবে ছোট দল হওয়া সত্ত্বেও দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য কথায় ও কাজে সবচেয়ে বড় বরকন্দাজ হয়ে উঠেছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই পাকিস্তান প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত নেতাদের রাজনৈতিক অবস্থান তাদের আগের অবস্থানের চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। যারা ভারত ভেঙে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তাদের জীবন-যৌবন বাজি রেখেছিলেন, তারাই পাকিস্তান সরকারের নানা দুর্বলতা, অনাচার, অবিচারের সুযোগ নিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা বিনষ্ট করতে অর্থাৎ তাদেরই প্রতিষ্ঠিত দেশ ভাঙতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, যারা ভারতের অখণ্ডতার পক্ষে কাজ করেছে এবং পাকিস্তান চায়নি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা তাদের ভোল পাল্টে পাকিস্তানকে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রে পরিণত করার আশায় দেশটির স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য জানমাল কোরবানি দিতে প্রস্তুত ছিল। জামায়াতে ইসলামী কীভাবে তাদের ভূমিকা পাল্টে ফেলল, এটাও কম বিস্ময়ের নয়। জামায়াতের পক্ষ থেকে যত ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক না কেন, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আধিপত্য বিস্তার হতে পারে আশঙ্কায় ১৯৭১ সালে তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী, তথা পাকিস্তান সরকারকে সহযোগিতা করেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে তারা পাকিস্তান রক্ষায় যেমন ভূমিকা রেখেছিল, তেমনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরীতে পরিণত হয়েছে। জামায়াতের এহেন দাবির সামনে স্বাধীনতার একচেটিয়া দাবিদার আওয়ামী লীগকেও মুখ আড়াল করতে হয়। কারণ যতবার আওয়ামী ক্ষমতায় এসেছে, তারা সব সময় দেশের উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণ সাধনের চেষ্টার পরিবর্তে ভারত সরকারকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের মতো একটি অনুগত সরকার ভারতের জন্য সব সময় আশীর্বাদ। ভারতের যে কোনো দলের সরকার বাংলাদেশে বারবার আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখতে চায়। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। তার সর্বশেষ প্রমাণ গত বছরের জুলাই-আগস্টে গণহত্যাসহ বহু অপরাধে অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে প্রত্যর্পণ না করা।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম মিলন ঘটে পাকিস্তান আমলে ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইউব খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী দলের (কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিজ-কপ) প্রার্থী পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন দানের ক্ষেত্রে। ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন দেওয়ার আগপর্যন্ত মাওলানা মওদুদী ও তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী এ মর্মে নারী নেতৃত্বের বিরোধিতা করেছে, ইসলামে নারী নেতৃত্বের বিধান নেই। এর পক্ষে মওদুদীর বক্তব্য ছিল : ‘এই নির্বাচনে যদি ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন না করা হয়, তাহলে একনায়ক আবারও জাতির ওপর চেপে বসবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার মতে, এ স্বৈরাচারের চেপে বসার সুযোগ দেওয়া একজন নারী নেতা নির্বাচিত করার চেয়ে দশ গুণ অধিক অপরাধ।’ জামায়াত নেতারা ফাতিমা জিন্নাহর সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে সারা দেশ সফর ও একই মঞ্চে বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের নির্বাচনি রাজনীতিতেও জামায়াতে ইসলামী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মাথা পেতে গ্রহণ করে ও বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনি জোট গঠন করে এবং সরকারে অংশ নিয়ে নারী নেতৃত্বের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ আস্থার প্রমাণ দিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী যেহেতু খোলাফায়ে রাশেদিনের আদলে সরকার গঠন ও পরিচালনা করতে চায়, অতএব তারা প্রথমদিকে সংসদীয় পদ্ধতিতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিল। তারা চাইত প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা। আধুনিক গণতন্ত্র সম্পর্কে জামায়াতের বিরূপ মনোভাব ছিল শুরু থেকে। মওদুদী তাঁর এক গ্রন্থে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন বিষাক্ত দুধের মাখনের মতো। ইসলাম অনুযায়ী কোনো পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া হারাম। এ ধরনের নির্বাচন প্রকৃতপক্ষে কুকুরের দৌড়।’ কিন্তু জামায়াতে ইসলামী মাওলানা মওদুদীর জীবদ্দশাতেই ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজেদের তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করে। জামায়াতের পক্ষে যেহেতু পাকিস্তানে কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা ছিল না, অতএব পার্লামেন্টে কিছু সদস্য নির্বাচিত হলে অন্তত দলের লক্ষ্য ও আদর্শের পক্ষে প্রচারণার ভালো সুযোগ পাওয়া যাবে বিবেচনায় জামায়াত পরবর্তী প্রায় সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দলের নামে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ব্যবহৃত তাদের নির্বাচনি প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসক এরশাদের অধীনে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। প্রথমে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। কারণ বিএনপি জামায়াতকে ১০০ আসন ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। জামায়াত নেতারা মনঃক্ষুণ্ন্ন হলেও প্রায় রাতারাতি আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতায় পৌঁছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা নিয়ে ৭৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জামায়াতের ১০ জন প্রার্থী জয়লাভ করলে তারা জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের পর জাতীয় সংসদে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অটল ছিল। এমনকি আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে নির্বাচন করায় বিএনপি আওয়ামী লীগকে ‘জাতীয় শত্রু’ বলে উল্লেখ করে। এরশাদের অধীনে সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না অজুহাতে ১৯৮৭ সালের ৩ ডিসেম্বর জামায়াতের ১০ সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তে সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগের পদত্যাগ করার কথা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সদস্যরা পদত্যাগ না করায় জামায়াত বিস্মিত হয়। এ বিস্ময়ের অবসান ঘটে ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করায়।
১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠায় জামায়াতে ইসলামী পুনরায় আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পায়। লিয়াজোঁ কমিটির মাধ্যমে তারা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। এরশাদের পতনের পর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দল আশা করেছিল যে গোপনীয়তা বজায় রেখে হলেও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াত তাদের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু জামায়াত আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপির সঙ্গে গোপন নির্বাচনি জোট বেঁধেছিল। নির্বাচনি ফলাফলে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কারোই সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৫১ আসন। বিএনপির প্রাপ্ত ১৪০-এর সঙ্গে জামায়াতের ১৮ সদস্যের সমর্থন পেলে সরকার গঠনে বিএনপির কোনো বিঘ্ন ঘটে না। আওয়ামী লীগও জামায়াতের সমর্থন চেয়ে দুতিয়ালি শুরু করে, তাদের প্রাপ্ত ৮৮, জাতীয় পার্টির ৩৫, জামায়াতের ১৮ সদস্য এবং ছোট দল ও স্বতন্ত্র সদস্য মিলিয়ে তারা কোয়ালিশন সরকার গঠন করে ফেলতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার গঠনে বিএনপিকেই সমর্থন দেয় জামায়াত। বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দিলেও জামায়াত সরকারে যোগ দেয়নি একটিমাত্র আশায় যে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকার দলের আমির গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করবে। সরকার তা না করে গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করে। উচ্চ আদালতের রায়ে গোলাম আযম তাঁর নাগরিকত্ব ফিরে পান। কিন্তু বিএনপির প্রতি জামায়াতের পুষে রাখা ক্ষোভের পরিণতি ছিল ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ও ২১ বছর পর তাদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। কিন্তু আওয়ামী লীগ জামায়াতকে কখনো এ কৃতিত্ব দেয়নি। জামায়াত ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সম্পর্কের এ টানাপোড়েনে উভয় দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার মিথ্যা অভিযোগে প্রহসনের বিচারে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করেছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে অতিষ্ঠ, ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন বিদ্রোহে শেখ হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ন্যক্কারজনকভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে।
লেখক : নিউইয়র্কপ্রবাসী, সিনিয়র সাংবাদিক