ফল-ফসলে সমৃদ্ধ গ্রাম বলতে যেমনটি বোঝায়, চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগরের রায়পুর গ্রাম যেন তারই প্রতিচ্ছবি। পাখির চোখে দেখলে মনে হয় ফসল বৈচিত্র্যে ভরপুর কৃষকের মাঠে রঙিন কার্পেট বিছানো। চার দশক ধরে বিভিন্ন দেশের কৃষিচিত্র দেখে যেমনটি ভেবেছি, আমার দেশের কৃষি খেত ভরে থাকবে উচ্চমূল্যের ফল-ফসলে, কৃষক থাকবেন সবচেয়ে এগিয়ে, তারুণ্যের শক্তিতে কৃষি অর্থনীতি হবে দারুণ টেকসই। ঠিক সেদিকেই যেন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ প্রভৃতি জেলাগুলো। বিগত দশকে তরুণদের হাতে ঘটেছে কৃষির অনন্য বিকাশ। কৃষি অগ্রসরতার কারণেই কভিড-১৯সহ নানা প্রতিকূলতার ভিতরেও বাংলাদেশের মানুষ খাদ্যঘাটতির মুখোমুখি হয়নি।
যাই হোক, রায়পুর গ্রামের সাদ্দাম হোসেন একজন উদ্যমী তরুণ। কৃষির প্রতি অনুরাগ থেকে অর্জন করেন কৃষি ডিপ্লোমা। তারপর চাকরি দিয়ে জীবিকা শুরু করলেও নতুন কৃষির টানে ফিরে এসেছেন মাঠে। আর নতুন নতুন ফল-ফসল চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন পুরো এলাকায়।
সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তাঁর ভাই হৃদয় হোসেনও যুক্ত এই কৃষি উদ্যোগে। নতুন নতুন ফল-ফসলের প্রতি তাঁদের আগ্রহের অন্যতম কারণ মূলত নার্সারি ব্যবসা। এখানে শত বিঘার ওপরে তাঁদের কৃষি কার্যক্রম। আছে নানান ধরনের বিদেশি ফল ফসলের চাষ। তবে এই সময়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় তাঁদের মিষ্টি আঙুরের বাগান। বিকালের উজ্জ্বল রোদে বিশাল জলাশয়ের পাশের এই বাগানে পেকে থাকা টসটসে আঙুর যে রং ছড়াচ্ছে, দেখে মনে হয় কোনো ভিনদেশের বাগান। কিন্তু না, বাংলাদেশের জমিন। এই জমিনে তরুণরা বিস্ময় ফলিয়ে যাচ্ছেন।
গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে দেশে আঙুর চাষের চেষ্টা চলেছে। দেশের মাটিতে আঙুরের ফলন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বাদ ছিল বেজায় টক। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তখনো জানত না আঙুর গাছ দেখতে কেমন। গাজীপুরের কাশিমপুর এস্টেটের আঙুর চাষের দৃশ্য টেলিভিশনে তুলে ধরার পর অনেক দর্শক চিঠি লিখেছিলেন। বলছিলেন, কোনোমতেই সেটি বাংলাদেশের দৃশ্য নয়। পরের সপ্তাহে পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের একদল শিক্ষার্থীর সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। শিক্ষার্থীরা গাছে থোকা থোকা আঙুর ঝুলে থাকতে দেখে অভিভূত হয়েছিল। কিন্তু আঙুর খেয়ে খুশি হতে পারেনি। কারণ সেই আঙুর ছিল টক। ফলে তখন আঙুর চাষের সম্প্রসারণ তেমন ঘটেনি। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে বাড়ির কোণে বা ছাদে অনেকেই আঙুর চাষের চেষ্টা করেছেন।
আঙুর চাষের উৎপত্তি মূলত পশ্চিম এশিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। বিশেষ করে বর্তমান ইরান, তুরস্ক এবং ককেশাস অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই আঙুরের চাষ হয়ে আসছে। ইতিহাসবিদদের মতে, ৬ থেকে ৮ হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম আঙুর চাষ শুরু করে এবং পরবর্তী সময়ে তা ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে আঙুর চাষের ইতিহাস একেবারেই নতুন। ফলভরা এই দেশে একসময় ভাবাই যেত না আঙুরের থোকা থোকা সৌন্দর্য দেখা যাবে। কিন্তু সময় বদলেছে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি আর কৃষকদের প্রচেষ্টায় এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠছে আঙুরের বাগান।
একেবারে নিজের চেষ্টা ও উদ্যোগে বিভিন্ন দেশ থেকে আনা ফলের চারা উৎপাদনের উপযোগিতা যাচাই করছেন সাদ্দাম হোসেন। কখনো সফল হচ্ছেন, কখনো বা ব্যর্থ।
সাদ্দাম হোসেন তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন, আঙুর চাষের জন্য আদর্শ জমি খুঁজে নেওয়াই প্রথম চ্যালেঞ্জ। জমিন এমন হওয়া দরকার, যেখানে পরিমিত বৃষ্টি হবে, কিন্তু মাটিতে পানি জমে থাকবে না। আবার আবহাওয়া হতে হবে শুষ্ক ও উষ্ণ। সাধারণত আঙুর পাকার সময় বৃষ্টি হলে আঙুরের গুণাগুণসহ আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। আবার পাখি আঙুর খেয়ে ফেলে বলে এ নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে। যথাযথ পরিচর্যা পেলে একটি আঙুর গাছই বছরের পর বছর ধরে ফলন দিতে পারে। তাই মূল বিনিয়োগ মূলত এককালীন।
বিদেশে এমন অনেক বাগান দেখেছি, যেখান থেকে দর্শনার্থীরা নিজের হাতে ফল হার্ভেস্ট করতে বা তুলতে পারে। নিজ হাতে তোলা ফল ন্যায্যমূল্যে কিনে নেওয়ার সুযোগও থাকে। এই বাগান থেকেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আঙুর। পাইকারি ক্রেতা লিমনের সঙ্গে কথা হয়। লিমন জানালেন, দেশি আঙুর বললে ক্রেতারা বিশ্বাস করেন না, বলেন দেশের আঙুর মিষ্টি হয় নাকি!
ব্যক্তি উদ্যোগে দেশে কৃষি অর্থনীতির এই চর্চাগুলো অগ্রসর হচ্ছে। এতে পুরোপুরি ঝুঁকি নিচ্ছেন কৃষক। তবে উদ্যোক্তা সাদ্দাম হোসেন বলছেন, সরকারের কৃষি বিভাগের পর্যাপ্ত সহযোগিতা থাকলে আরও বেশি দূর অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাওয়া যেত।
সাদ্দামের আঙুরবাগান এখন যেন একটা অনুপ্রেরণার নাম। এই এলাকার মাটিতে যে আঙুরের মতো বিদেশি ফল চাষ হতে পারে, তা আগে কেউ কল্পনাও করেনি। কিন্তু সাদ্দাম সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। তাঁর সফলতা দেখে এলাকার অনেকেই স্বপ্ন দেখছেন- তাঁরাও একদিন এই মাটিতে আঙুর ফলাবেন, গড়ে তুলবেন নিজেদের বাগান।
বাগানে ঘোরাঘুরির সময় কয়েকজন নবীন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হলো। তাঁদের চোখমুখে ছিল আত্মবিশ্বাস আর আশার আলো। একজন বললেন, ‘সাদ্দাম ভাই শুধু একজন কৃষক নন, তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। আগে ভাবতাম এই মাটিতে ধান বা শাকসবজিই চাষ হবে, কিন্তু এখন বিশ্বাস হচ্ছে- যদি ইচ্ছা থাকে আর সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়, তাহলে আঙুর চাষও সম্ভব।’
আরেকজন বললেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে সাদ্দাম ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি আমাদের পরামর্শ দিচ্ছেন। আমরা ছোট ছোট জায়গা থেকে শুরু করতে চাই। ধীরে ধীরে বাগান বড় করব। শুধু টাকাপয়সার কথা ভাবছি না- যদি সঠিকভাবে এই চাষ কৌশল রপ্ত করতে পারি, তাহলে আমাদের গ্রামে অনেক মানুষের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি হবে। যুবসমাজকে ধরে রাখা যাবে।’
বিষয়টা এখন আর শুধু কৃষির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এক উদ্যোক্তা বলছিলেন, ‘সাদ্দামের বাগান দেখতে এখন নানা জায়গা থেকে মানুষ আসে। কিছুটা পর্যটনের মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আবার বাজারেও এই আঙুরের চাহিদা বাড়ছে। আগে বাইরের ফলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো, এখন নিজেরাই যদি উৎপাদন করতে পারি, তাহলে সেটা একটা বড় অগ্রগতি হবে। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে আমাদের এলাকা আঙুর চাষের জন্য আলাদাভাবে পরিচিতি পাবে।’
কথাগুলো শুনে মনে হলো, এই বাগান যেন একটা নতুন আশা, নতুন স্বপ্নের নাম। সাদ্দাম দেখিয়েছেন, সাহস আর পরিশ্রম থাকলে নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে নতুন দিগন্তে পৌঁছানো সম্ভব।
সাদ্দাম হোসেনের মতো তরুণদের নিরলস চেষ্টা দেখিয়ে দিচ্ছে, সঠিক পরিকল্পনা, ধৈর্য আর উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে দেশের কৃষিই হয়ে উঠতে পারে টেকসই উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি। উদ্যোক্তাদের প্রতি অনুরোধ, অন্যের সাফল্য দেখে অতি উৎসাহে বড় বিনিয়োগে যাবেন না। বিনিয়োগের আগে উৎপাদন কৌশল, বাজার পরিস্থিতি এবং নিজের সামর্থ্য যাচাই করে নিতে হবে। সুপরিকল্পিত বিনিয়োগে সাফল্যের সুযোগ আছে। পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারের কৃষি বিভাগের সহযোগিতা। আমার বিশ্বাস প্রশিক্ষণ সহায়তা, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আর কৃষিপণ্যকে মূল্যায়নের রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি পেলে মিষ্টি আঙুরের স্বাদ ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে।
শাইখ সিরাজ
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব