যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায়, উত্তরাধিকারীদের জন্য তৎক্ষণাৎ কয়েকটি কাজ আবশ্যক হয়ে যায়। মৃতের দাফনকাফন, তার ওসিয়ত পূরণ, ঋণ পরিশোধ এবং কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ওয়ারিশদের মাঝে তার পরিত্যক্ত সম্পদের সঠিক বণ্টন। প্রথম তিনটি মোটামুটিভাবে আদায় করা হলেও চতুর্থটিতে এসে আমাদের অবহেলা শুরু হয়। আমরা যথাসময়ে, যথানিয়মে মৃতের সম্পদ বণ্টন করি না। এর পেছনে অবশ্য সামাজিক ট্যাবুর দায় আছে। কারও মৃত্যুর সপ্তাহখানেকের ভিতর জমিজমার ভাগবাঁটোয়ারা করা হলে লোকজন নিন্দা করে বলে, মানুষটা মাত্র মারা গেল, এখনো কবরের মাটি শুকাল না, অথচ সন্তানরা এখনই তার সম্পত্তি ভাগবাঁটোয়ারা শুরু করেছে। বাহ্যিকভাবে শুনতে ভালো শোনালেও এর ভিতর অনেক সমস্যার বীজ লুকিয়ে আছে। পরিত্যক্ত সম্পদ তৎক্ষণাৎ বণ্টন না করলে সহসা আর বণ্টন করা হয়েও ওঠে না। ফলে মৃতের সমুদয় সম্পত্তি অল্প কয়েকজন মানুষের হাতে বন্দি হয়ে পড়ে। মৃতের অন্যান্য উত্তরাধিকার তাৎক্ষণিক মালিকানা লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। এ কারণেই দেখা যায়, অনেক নারী জীবনসায়াহ্নে এসেও বাবার বাড়ির জমির দখল পান না। মায়ের মৃত্যুর পর তার সন্তানরা নানাবাড়ির সম্পদের জন্য লড়াই করে।
উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার হন নারী। এই বঞ্চনার পেছনের পুরুষ একটা যুক্তি দাঁড় করায়- বাবার মৃত্যুর পর বোনের লেখাপড়া করিয়েছি, অনেক খরচ করে তার বিয়ে দিয়েছি। এরপর কীভাবে সে সম্পদের ভাগ পায়! মনে রাখতে হবে, বাবার অবর্তমানে বোনের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ভাইয়ের। এটা বোনের অধিকার। আবার উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ পাওয়াও তার অধিকার। এক অধিকার পাওয়ার কারণে অন্য অধিকার নষ্ট হয়ে যায় না। বোনের প্রতি কর্তব্য পালন করে ভাই যে অর্থ ব্যয় করেন তার বিনিময় তিনি আল্লাহর কাছে পাবেন। সুতরাং মৃত বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া অধিকারের সঙ্গে বিয়ের খরচের সমন্বয় করা একটি অবিচার। এই অবিচারের শিকার এ দেশের কোটি কোটি নারী।
অনেক বাবা-মাও মেয়েদের বঞ্চিত করেন। তাদের ধারণা- ছেলেকে দিলে সম্পদ নিজের বাড়িতে থাকবে, মেয়েকে দিলে বেহাত হয়ে যাবে, পরের বাড়িতে চলে যাবে। শেষ জীবনে ছেলেরা বাবা-মায়ের পাশে থাকবে, মেয়েরা থাকবে না। আমাদের এই কুমনোবৃত্তির কারণেই আল্লাহ উত্তরাধিকার সম্পদের বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন, তোমরা আসলে জানো না, তোমাদের পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে কে বেশি উপকারে আসবে (সুরা নিসা)।
অধিকাংশ পিতা-মাতা মেয়ের তুলনায় ছেলেকে বেশি ভালোবাসেন, ছেলের প্রতি বেশি পক্ষপাতিত্ব দেখান। বিয়ের পর মেয়ে তো অন্যের হয়ে যাবে-এই ভ্রান্ত ভাবনাই এই পক্ষপাতিত্বের কারণ। অথচ বাস্তব জীবনে আমরা উল্টো চিত্র দেখতে পাই। আমরা দেখি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরাই বাবা-মার প্রতি বেশি যত্নশীল হয়। সাংসারিক জীবনে কোনো সংকট তৈরি হলে মেয়েরা স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে বাবা-মার পক্ষে অবস্থান নেয় আর ছেলেরা বাবা-মার বিরুদ্ধে গিয়ে অবস্থান নেয় বউয়ের পক্ষে। শুধু তা-ই নয়, অনেক বাবা-মার শেষ জীবনের আশ্রয় হয় ওই অবহেলিত মেয়ের ঘর। সব ক্ষেত্রে হয়তো এমনটা ঘটে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটে। তাই শেষ জীবনের সম্বল ভেবে আপনি যাকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছেন, হতে পারে তার কাছ থেকেই আপনি সবচেয়ে বেশি অবহেলা পাবেন।
এ দেশে নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। অথচ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, এ দেশের মাত্র ৪ শতাংশ জমির মালিক নারী। বাকি ৯৬ শতাংশ জমির মালিক পুরুষ। কী ভয়াবহ অবস্থা। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, যুগ যুগ ধরে এ দেশের নারীদের কীভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে!
কোরআনের যত জায়গা আল্লাহ মিরাসের আলোচনা করেছেন, প্রত্যেকটা আয়াতই অনেক দীর্ঘ। মিরাসের গুরুত্বই এই দীর্ঘতার কারণ। অর্থাৎ আল্লাহ যেখানে যেখানে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন, অন্য প্রসঙ্গ তোলেননি। পুরো আলোচনা শেষ করে পূর্ণ যতিচিহ্ন দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেছেন। এর মাধ্যমেও মিরাসের গুরুত্বের বিষয়টি প্রতিভাত হয়। আমরা কত অবলীলায় বোনের অধিকার নষ্ট করছি অথচ এ বিষয়ে অত্যন্ত ভয়ংকর সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন রসুল (সা.)। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত জমিও দখল করে, কেয়ামতের দিন সাত স্তরের জমিন তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে (বোখারি)। ভাবুন একটুখানি সচ্ছলতার জন্য আপনি বোনকে ঠকাচ্ছেন, দুনিয়াতে মানুষ আপনাকে ঠগবাজ তো বলছেই, কেয়ামতের দিনও আপনাকে লাঞ্ছিত হতে হবে। এক বস্তা মাটি যদি আপনার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, আপনার ঘাড় ভেঙে যাবে। সেদিন সাত স্তরের জমিন গলায় নিয়ে আপনি কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন! নারীদের সম্পদ সঠিকভাবে নারীদের হাতে তুলে দিতে একটি সামাজিক জাগরণ প্রয়োজন। আসুন সেই জাগরণে আপনি আমি সবাই শামিল হই।
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ