রমজান মাস ইবাদতের বসন্তকাল, এ কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু রমজানের বাইরে যে আরও একটি ইবাদতের বসন্তকাল আছে, সেটা আমরা খুব কম মানুষই জানি। সেই বসন্তকাল হলো জিলহজের প্রথম ১০ দিন। এ দিনগুলো আল্লাহর কাছে এত প্রিয়, এই সময়ের আমলের মাধ্যমে একজন বান্দা অতি সহজে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পারে।
মহান আল্লাহ সুরা ফজরের ২ নম্বর আয়াতে ১০ রাতের কসম করেছেন। অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে এখানে ১০ রাত বলতে জিলহজের প্রথম ১০ রাত উদ্দেশ্য। আর স্বয়ং আল্লাহ যখন কোনো সময়ের কসম খান, এর গুরুত্ব যে কতখানি, তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। এ ছাড়া সুরা হজের ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তারা যেন আল্লাহর নাম স্মরণ করে নির্দিষ্ট দিনসমূহে।’ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘নির্দিষ্ট দিন বলে এখানে জিলহজের প্রথম দশক বোঝানো হয়েছে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
রসুল (সা.) বলেছেন, জিলহজের প্রথম ১০ দিনের নেক আমল আল্লাহর কাছে যত প্রিয়, আর কোনো দিনের আমল তত প্রিয় নয়। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, আল্লাহর পথে জিহাদও কি তার চেয়ে প্রিয় নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহর পথে জিহাদও এ ১০ দিনের নেক আমলের চেয়ে প্রিয়তর নয়, তবে ওই ব্যক্তির কথা ভিন্ন, যে নিজের প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে জিহাদে বেরিয়ে গেল এবং কোনো কিছু নিয়ে আর ফিরে এলো না। (বোখারি)
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ দিনসমূহ হলো জিলহজের প্রথম ১০ দিন।’ (আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব) জিলহজের তাৎপর্যের বিষয়ে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘জিলহজের প্রথম দশকের বিশেষ গুরুত্বের কারণ হলো এ দিনগুলোতে ইসলামের পাঁচটি মৌলিক কাজের সমাহার রয়েছে। যেমন ইমান ও সালাত অন্য দিনগুলোর মতো এ দিনগুলোতেও বিদ্যমান। জাকাত বছরের অন্য যে কোনো সময়ের মতো এ সময়েও আদায় করা যায়। আরাফার দিনে রোজার নির্দেশ থাকায় ইসলামের আরেকটি রুকন রোজার নজিরও এ দশকে পাওয়া যায়। আর পঞ্চম রুকন হজ এ দশকেই পালনযোগ্য। আবার ইসলামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কোরবানিও এ সময়ে আদায় করতে হয়।’ সুতরাং মাস হিসেবে রমজান আর দিন হিসেবে জিলহজের প্রথম দশক শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ। আর তাই একজন ইমানদারের এ দিনগুলোতে ইবাদতে বিশেষভাবে মগ্ন হওয়া উচিত।
কোরআন-হাদিসের আলোকে এ দশকের বেশ কিছু আমল
১. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির বা স্মরণ করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যেন তারা তাদের জন্য স্থাপিত কল্যাণসমুহ প্রত্যক্ষ করে এবং নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ : ২৮) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আয়াতে নির্দিষ্ট দিন বলে জিলহজের প্রথম দশককে বোঝানো হয়েছে।
২. নেক আমল ও ভালো কাজের প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হওয়া। কেননা মহান আল্লাহর কাছে অন্যান্য সময়ের আমলের চেয়ে জিলহজের প্রথম ১০ দিনের আমল অধিক প্রিয়।
৩. অন্য সময়ের তুলনায় এ দিনগুলোতে পাপ কাজ পরিহারে অধিক সচেষ্ট থাকা।
৪. সামর্থ্যবান হলে হজ করা। কেননা হজ ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের একটি। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের ওপর হজ ফরজ। আবার কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া অন্য কিছ্ ুনয় মর্মে নবীজি (সা.)-এর সুসংবাদ রয়েছে।
৫. সামর্থ্য থাকলে কোরবানি করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি নিজ প্রতিপালকের জন্য সালাত আদায় করো ও কোরবানি করো।’ (সুরা কাউসার : ২)
৬. কোরবানি করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির কোরবানির আগ পর্যন্ত নখ, চুল ও অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা থেকে বিরত থাকা। তবে বিভিন্ন বর্ণনায়, যাদের কোরবানি করার সামর্থ্য নেই, তারাও ফজিলতপূর্ণ এ আমলটি করতে পারে।
৭. তাকবির, তাহমিদ ও তাহলিল পাঠ করা। অর্থাৎ ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ পড়া।
৮. ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত প্রতি নামাজের পর একবার তাকবির পাঠ করা।
৯. প্রথম নয় দিন রোজা রাখা। কোনো কোনো বর্ণনায় জিলহজের প্রথম নয় দিনই রোজা রাখার নির্দেশনা পাওয়া যায়। তা ছাড়া এ দিনগুলোর নেক কাজ আল্লাহর প্রিয় হওয়ায় এর সব দিনেই নফল সিয়াম রাখা যায়। অনেক ইমামও জিলহজের প্রথম নয় দিন সিয়াম পালন করাকে মুস্তাহাব বলেছেন।
১০. আরাফার দিন বিশেষভাবে রোজা রাখা। কেননা এদিন রোজা রাখলে আশা করা যায় মহান আল্লাহ তার পেছনের এবং সামনের এক বছরের (সগিরা) গুনা ক্ষমা করে দেবেন।
১১. ঈদের দিনের সুন্নতসমূূহ : জিলহজের প্রথম দশক এমন বসন্তকাল, যা পেয়েও আমাদের হৃদয় আন্দোলিত হয় না!
আসুন, এ দিনগুলোর কদর করি, আমলের শূন্য উদ্যানে সবুজ বৃক্ষ রোপণ করি।
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ