আদর্শবান ছাত্র দেশের একটি বড় সম্পদ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের বাংলাদেশের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অধিকার আদায়েও ছাত্রদের থাকে একটি বড় ভূমিকা। তাদের কখনো কখনো রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে অভ্যুত্থান হয়েছে, তার ফলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এক নতুন স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে বরাবরই শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী গণ আন্দোলন, সর্বশেষ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেড় যুগের শাসন অবসানে শিক্ষার্থীরাই অগ্রভাগে থেকে গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের উদ্যোগ ও নেতৃত্বেই হাসিনার পতন ও পলায়ন ঘটে। জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
সব আন্দোলন সফল করে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে ফিরে শিক্ষায় মনোনিবেশ করেছে। ছাত্রদের মূল অধ্যয়ন হলেও সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ, আদবকায়দা ইত্যাদি মানবিক গুণচর্চা করাও তাদের দায়িত্ব। ছাত্রজীবনের সব সঞ্চয়ই ব্যক্তিজীবনের পরবর্তী সব পদক্ষেপে কাজে লাগে। তাই সৎ-চরিত্রবান হতে হলে সততার চর্চা করা, সত্যবাদী হওয়া, নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া ইত্যাদি সদ্গুণ ছাত্রজীবনে অনুশীলন করা ছাত্রদের কর্তব্য। তবে ইদানীং দেখা যাচ্ছে, স্কুলছাত্রদের অনেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অভিভাবকদের অগোচরে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। যুক্ত হচ্ছে এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিশেষ শাখা (সিটিএসবি) এ বিষয়ে একটি জরিপ চালায়। এতে ভিত্তি ধরা হয় (২০২৩ সালের) উপস্থিতির হার। জরিপ চালানো হয় ৭৮২ জন শিক্ষার্থীর ওপর। তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নবম-দশম শ্রেণিতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি গড়ে ৪৬ শতাংশ। অনুপস্থিত থাকা ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ ছাত্র, যাদের অনেকে জড়িয়ে পড়েছে অপরাধে। নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সামাজিক অস্থিরতা ও কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানের কারণ খুঁজতে গিয়ে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পায় পুলিশ। এসব ছাত্র পর্নোগ্রাফি, সাইবার অপরাধ, ছিনতাই, চুরি, মাদক নেওয়া ও কেনাবেচা এবং অনলাইন জুয়ার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে তারা বেছে নেয় স্কুলের সময়টা। এমনকি স্কুলের সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। সেখানে দেখা গেছে নবম ও দশম শ্রেণির অনেক ছাত্রের অপরাধের শুরু হিরোইজম (বীরত্ব) দেখানো থেকে। প্রথমে চুরি-ছিনতাই ও মাদকের নেশায় জড়ায়। এরপর নেশার টাকা জোগাড় করা ও নানা অপরাধ করে পার পেয়ে যেতে আশ্রয় নেয় এলাকাভিত্তিক বড় ভাইদের কাছে। বড় ভাইয়েরা অপরাধমূলক কাজে কিশোরদের ব্যবহার করেন। গুরুতর অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে অনেকে। অনেক সময় দেখা গেছে পরিবারও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিশোর গ্যাংয়ের বড় ভাইদের সংস্পর্শে আসার পর আচরণেও নেতিবাচক পরিবর্তন হয়। দেখা গেছে, ক্লাসে উপস্থিত না থাকায় অন্তত ৯ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সমাজে পড়ছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে সহপাঠীর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করছে। সহপাঠীকে শায়েস্তা করতে অপরজনও কোনো না কোনো কিশোর গ্যাং অথবা কথিত রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের ছত্রছায়ায় যাচ্ছে। ক্লাস চলাকালে শহরের বিভিন্ন পার্ক, রেস্টুরেন্ট, বিনোদন স্পট, ডার্ক রেস্টুরেন্ট, মার্কেট ও সিনেমা হলে তাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। স্কুলের খেলাধুলা, চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাসহ নানা অনুষ্ঠানে তারা আগ্রহ হারাচ্ছে। এতে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের একটি অংশ সাইবার জগতে সময় দিচ্ছে। অনলাইনভিত্তিক ভিডিও গেমসের নেশায় বুঁদ হচ্ছে। জুয়ার নেশা পেয়ে বসছে। জন্মদিন, ভ্যালেনটাইন ডেসহ বিভিন্ন উপলক্ষ্য সামনে রেখে রেস্টুরেন্ট-পার্কে সময় কাটাচ্ছে। এসব উদ্যাপন করার নামে বিকৃত সংস্কৃতিচর্চায় জড়িয়ে পড়ছে। সিগারেট-মাদকের পয়সা জোগাড় করতে চুরি, ছিনতাই এমনকি ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ছে।
২০১৭ সালে উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি আলোচনায় আসে। সে সময় চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে র্যাব। পরে উত্তরা, গাজীপুরসহ কয়েকটি এলাকায় স্কুলছাত্র শুভসহ আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ২০১৭ সাল থেকে র্যাব গত বছরের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের ১ হাজার ১২৬ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে ৪০ জনকে জরিমানা ও মুচলেকা নিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে র্যাবের অভিযানে কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন গ্রুপের ৩৪৯ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমি মনে করি, স্কুল-কলেজে যদি একটি নির্দিষ্ট হারে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য