বাড়ির অদূরে একটি বড় দিঘি। দিঘির পাড়ে সারি সারি সবুজ বৃক্ষ। পড়ন্ত বিকালে দিঘির পাড়ের বৃক্ষগুলোর শীতল ছায়া। দিঘির এক পাড়ে একটি সুদৃশ্য পাকা ঘাট। দিঘির স্বচ্ছ পানিতে মাছের খেলা। এসব দৃশ্য এখন অনেকটাই কল্পনায় ঠেকেছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এমন দৃশ্য প্রায় অপরিচিত। বিরলও বটে। গ্রাম পর্যায়ে কিছু এলাকায় কদাচিৎ এমন দৃশ্যপটের দেখা মিললেও শহুরে জীবনে তা সম্পূর্ণ দূর অতীত। শহরের ইট-কংক্রিটের থাবায় হারিয়ে গেছে প্রায় সব দিঘি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ গিলে খেয়েছে দিঘিগুলো। স্মৃতির বাতায়নে ডুব দিলেও এখন এমন চিত্রের সন্ধান পাওয়া দুরূহ।
দখল, দূষণ ও ভরাটের কবলে পড়ে হারিয়ে গেছে ঐতিহাসিক শতবর্ষী প্রাচীন সব দিঘি। অনেক জায়গায় আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে দিঘিগুলো। ক্রমেই ভরাট-দখলের কবলে পড়ে বিপর্যস্ত। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক দিঘিগুলো। বিলীন হচ্ছে মোগল আমলে এই জনপদে খনন হওয়া দিঘি-পুকুর। বেদখলে সংকুচিত হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, বর্তমান প্রজন্মের কাছে কি সুদৃশ্য দিঘি কল্পনার বিষয়ই হয়ে গেল? চট্টগ্রামে গত ৪০ বছরে ২৪ হাজারের মতো পুকুর-দিঘি-জলাশয় ভরাট হয়েছে।
চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর ‘চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা’ গ্রন্থে পুকুরের সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের সম্পর্কের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখেন ‘চট্টগ্রামের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষ প্রায় সব বাড়ির পেছন দিকে মেয়েদের পুকুর, সামনের দিকে পুরুষদের পুকুর-মোট দুটি করে পুকুর থাকত। বাড়ির পেছনে পুকুর না থাকলে সেকালে ভালো বৈবাহিক সম্পর্ক করা যেত না।’ চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধির ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তি, বংশ ও এলাকার নামে ৩৭৬টি দিঘি খনন করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে এসব দিঘির অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে।
দুই. চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন ‘আসকার দিঘি’।
একসময় এটি ছিল নয়নাভিরাম। কিন্তু এখন দিঘিটি দখল হচ্ছে ক্রমশ। প্রতিদিনই একটু একটু করে ভরাট হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে স্থাপনা। বর্তমানে আসকার দিঘিকে আর দিঘির মতো মনে হবে না। চারদিকে কচুরিপানায় পূর্ণ। পানির পরিমাণ খুবই কম। নিয়মিত ফেলা হয় পলিথিন, পয়োবর্জ্য, গৃহস্থালি ও নানা আবর্জনা। ক্রমেই ছোট হচ্ছে দিঘির আয়তন। হারাচ্ছে সৌন্দর্য।
অন্যদিকে নগরের বলুয়ার দিঘিটিও ২০০ বছরের পুরোনো। এটিও দখলদূষণের শিকার। কাগজে দিঘির আয়তন সাড়ে ছয় কানির কথা বলা হলেও বাস্তবে অর্ধেকও নেই। দিঘির জায়গা দখল করে হয়েছে বহুতল ভবন-বাণিজ্যিক স্থাপনা। এই দিঘির পাশেই আছে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ, টেরিবাজারসহ দেশের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক মার্কেট। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ দিঘি আশীর্বাদ হলেও এখন তার সুফল মেলে না। তা ছাড়া রানীর দিঘি নগরীর একটি ঐতিহ্যবাহী দিঘি। এ দিঘির সঙ্গে অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত। এটিও দখলদূষণে ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। এভাবে নগরীর সব দিঘি ক্রমেই ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে। অনেক এলাকার নামকরণ হয়েছে পুকুরকে ঘিরে। কিন্তু এখন এলাকার নাম থাকলেও পুকুর বা দিঘি নেই। অথচ ১৯৬১, ১৯৯৫ এবং ২০২০ সালের নগর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনায় দিঘি রক্ষার কথা বলা আছে। কোনোমতেই দিঘি ভরাট-দখল-দূষণ করা যাবে না। নির্মাণ করা যাবে না স্থাপনা। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
চট্টগ্রামের শতবর্ষী প্রাচীন, ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ ও ঐতিহ্যবাহী উল্লেখযোগ্য দিঘিগুলোর মধ্যে আছে, আসকার দিঘি, রানীর দিঘি, বলুয়ার দিঘি, চকবাজারের কমলদহ দিঘি, ভেলুয়ার দিঘি, কাট্টলীর মালকা বানুর দিঘি, উত্তর কাট্টলীর চৌধুরী দিঘি, দক্ষিণ হালিশহরের হামজার দিঘি, খাজার দিঘি, মধ্যম হালিশহরের কলসির দিঘি, হাজি কাশেমের দিঘি, বদর শাহ্ মাজারের পাশসংলগ্ন পুকুর, বায়েজিদ বোস্তামীর দিঘি, পাহাড়তলীর পদ্মপুকুর, বড়মিয়ার মসজিদ পুকুর, আগ্রাবাদ ঢেবা, আগ্রাবাদের দাম্মো দিঘি, কর্নেল হাট দিঘি, হাজারির দিঘি, কাজীর দিঘি, উত্তর আগ্রাবাদ মুহুরী পাড়ার ময়লা পুকুর, কাট্টলীর পদ্মপুকুর দিঘি, উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দিঘি, হামজারবাগের হামজা খাঁ দিঘি। উপজেলার মধ্যে আছে, মিরসরাই থানার পরাগলপুরের ছুটি খাঁ দিঘি, হাটহাজারীর ফতেয়াবাদের নসরত শাহর ঘি, আলাওলের দিঘি, ফতেয়াবাদ ক্ষেত্রপাল বাড়ির শতবর্ষী পুকুর।
তিন. দিঘিগুলো পরিবেশের প্রাণ। পরিবেশ রক্ষা এবং মানুষের স্বার্থেই এসব দিঘি-জলাশয় বাঁচানোর কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে কোনোরকম অবশিষ্ট থাকা দিঘিগুলো বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। দিঘিগুলো বাঁচাতে প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। দিঘি, জলাশয় ও পুকুর রক্ষা এবং তা ফিরিয়ে আনতে সামাজিক আন্দোলন বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একই সঙ্গে দরকার দিঘিগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া। কোনো বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নয়-পরিবেশ, মানুষ, প্রকৃতি, প্রজন্মের স্বার্থে এবং আগামীকে বাঁচাতে বড় প্রয়োজন দিঘিগুলো। প্রজন্মের জন্য বাঁচুক ঐতিহ্যের এই প্রাচীন স্মারক দিঘি।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী