বুধবার, ১২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঢাকাই চলচ্চিত্রে অশনিসংকেত

ঢাকাই চলচ্চিত্রে অশনিসংকেত

ঢাকাই চলচ্চিত্র অশনিসংকেতের কবলে পড়েছে দেড় যুগেরও বেশি সময় আগে। এই শিল্পের ওপর ভর করা রাহুর দশা কোনোভাবেই কাটছে না। এতে শিল্পটি যেন ধীরে ধীরে গুটিয়ে যাচ্ছে। সরকারি আশ্বাসে বিশ্বাস করেও ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে পাচ্ছেন না চলচ্চিত্রকাররা। অশনিসংকেতে পড়া এ শিল্পের  অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

মানসম্মত পর্যাপ্ত ছবি নেই

দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ ধরেই মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবির অভাবে লোকসান গুনছে সিনেমা হল মালিকরা। আর বেকার হচ্ছে পরিচালক, শিল্পী, কলা-কুশলীরা। লোকসান গুনছে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা এফডিসিও। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদ বার বার বলছেন, স্থানীয়ভাবে নির্মাতারা মান সম্মত ও পর্যাপ্ত ছবি দিতে পারছেন না আবার চলচ্চিত্র পরিবার উপমহাদেশীয় ছবি আমদানিতেও বাধা দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে দু’একটি ছবি হিট হলে তা দিয়ে তো সারা বছর সিনেমা হল চালানোর খরচ উঠে আসে না। এই ঈদে সবচেয়ে কম ছবি মুক্তি পেয়েছে। ঈদের পর মুক্তি দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ও মান সম্মত ছবি নেই। এ অবস্থায় সিনেমা হলের অস্তিত্ব কীভাবে রক্ষা হবে। সিনেমা হল না থাকলে চলচ্চিত্র শিল্পই তো থাকবে না। বিষয়টি সরকারকে বিবেচনা করতে হবে।

 

প্রযোজক সংকট চরমে

চলচ্চিত্রের ব্যবসা মন্দার কবলে পড়ায় কেউ এখন আর এ খাতে অর্থ লগ্নি করতে চাইছে না। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এবং নতুন নামি দামি বেশির ভাগ প্রযোজনা সংস্থা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীন উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, ২০০০ সালের শুরু থেকে চলচ্চিত্র ব্যবসায় ধস নামলে প্রসিদ্ধ প্রযোজনা সংস্থাগুলো বন্ধ হতে থাকে। গত এপ্রিল মাসে বন্ধ হলো হিমেল খানের ‘মিনা ফিল্মস’। ২০০৭ সালে কাকরাইলে এসে জড়ো হয় শতাধিক প্রযোজনা সংস্থা। এর মধ্যে শুধু ভূঁইয়া ম্যানশনেই ছিল অর্ধ শতাধিক প্রোডাকশন হাউস। সিনেমা ব্যবসা মন্দার কারণে বন্ধ হতে হতে এখন এখানে রয়েছে মাত্র ৪/৫টি প্রযোজনা অফিস। এরমধ্যে কাউসারের তুষার কথাচিত্র, তাপসী ঠাকুরের হার্টবিট এবং সেলিম খানের ‘শাপলা মিডিয়া’ অন্যতম। মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, এখন প্রায় প্রযোজক ওয়ান টাইম ছবি নির্মাণ করেন, তাদের নিজস্ব কোনো অফিস বা ঠিকানা নেই। ফলে সিনেমা হল মালিকরা এসব প্রযোজককে অগ্রিম দিতে সাহস পান না। কারণ ছবি যদি না চলে তাহলে সেই অগ্রিম টাকা ফেরত নিতে কার কাছে বা কোন ঠিকানায় প্রদর্শকরা যাবেন। এদিকে যারা আগ্রহী হয়ে ছবি নির্মাণ করতে আসছেন তারাও নানা সহযোগিতার অভাবে হতাশ হয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি প্রযোজনায় আসা এসজি প্রোডাকশন গত নভেম্বরে মুক্তি দিয়েছে ‘অন্ধকার জগত’ ছবিটি। এ ছবির প্রযোজক মাহাবুবা শাহরীন বলেন, এফডিসিতে পার্টি হতে এবং যন্ত্রপাতি ও ফ্লোর ভাড়া নিতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। এত সময় নষ্ট ও লোকসান গুনতে হয় প্রযোজককে। এরপর ছবি মুক্তি দিতে গেলে আবারও হয়রানি। সিনেমা হলের প্রজেক্টর ভাড়া গুনতে গিয়ে নাকাল হতে হয়। সিনেমা প্রদর্শনের পর প্রযোজককে নানা অজুহাতে অর্থ বঞ্চিত করে সিনেমা হল মালিকরা।

 

সিনেমা হল বন্ধ চলছেই

সিনেমা হল বন্ধের হিড়িক কোনোভাবেই থামছে না। গত এপ্রিলে বন্ধ হলো নারায়ণগঞ্জের জোড়া সিনেমা হল-খ্যাত ‘আশা’ ও ‘মাশা’। এর মালিকপক্ষ বলছেন, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে দর্শক নেই। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী মাহাবুব হোসেন টানবাজারের সুতা ব্যবসায়ীদের জন্য ১৯৬০ সালে ‘আশা’ সিনেমা হলটি নির্মাণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাহাবুব হোসেন তার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া মাশার নামে আশা সিনেমা হলের সঙ্গে ‘মাশা’ নামের হলটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে প্রয়াত মাহাবুব হোসেনের ছোট ছেলে মেহমুদ হোসেনই এই জোড়া সিনেমা হলের দেখাশোনা করতেন। ব্যবসায়িক মন্দার কারণে এপ্রিলে আশা ও মাশা ভেঙে ফেলা শুরু করেন তিনি। এর ফলে নারায়ণগঞ্জে থাকা ছয়টি সিনেমা হলের মধ্যে এখন অবশিষ্ট রয়েছে ‘নিউ মেট্রো’ ও ‘গুলশান’। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৪৩৫টি সিনেমা হল চালু ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা ১৭২। এর মধ্যে ৯০টির মতো সিনেমা হলের পরিবেশ দর্শক উপযোগী। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন সরকার আশ্বাস দিয়ে আসছিল সিনেমা হলে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন, সিনেমা হল সংস্কার ও সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।

প্রযোজক সমিতির সাবেক কর্মকর্তা খোরশেদ আলম খসরু বলেন, স্বল্পসংখ্যক সিনেমা হল দিয়ে মাঝারি বাজেটের ছবির অর্থ ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। তাই ছবি নির্মাণ থেকে দূরে সরছেন নির্মাতারা। অনেকে এখন বাধ্য হয়ে ওয়েব ফিল্মের দিকেই ছুটছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে চিরতরে হারিয়ে যাবে আমাদের চলচ্চিত্র।

 

আরও সংকট...

চলচ্চিত্রকারদের কথায় এসব সংকট ছাড়াও দক্ষ তারকা, নির্মাতা, গান ও গল্প সংকট অন্যতম। দেশীয় মৌলিক গল্প বাদ দিয়ে সবাই ছুটেছে বিদেশি গল্পের নকলের পেছনে। দর্শক তো আর বোকা নয়, উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে নকল ছবি বানিয়ে দর্শকদের ধোঁকা দেওয়ার সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন একমাত্র শাকিব খানের ওপর নির্ভর করে চলছে এই শিল্প। একজনের পক্ষে বছরে কটি মানসম্মত ছবি উপহার দেওয়া সম্ভব, এ প্রশ্ন থেকেই যায়। নির্মাতা ও শিল্পীদের প্রশিক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই।

চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন বলেন,  ইতিমধ্যে পরিচালক সমিতি ও প্রদর্শক সমিতি তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই শিল্পের যাবতীয় সমস্যার চিত্র তার সামনে তুলে ধরেছে। তিনি সমস্যা সমাধানের আশ্বাসও দিয়েছেন। বর্তমান সরকার এই শিল্পের প্রতি বরাবরই আন্তরিক।

এখন উত্থাপিত সমস্যার সমাধান করে দিলেই চলচ্চিত্র শিল্প আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে।

সর্বশেষ খবর