আজ নায়করাজের জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে কী বলবেন?
রাজ্জাক ভাই তো একটা ইনস্টিটিউশন। তাঁর হাত ধরেই তো আমার চলচ্চিত্রে আসা। তাঁর কাছ থেকেই আমি সব শিখেছি। রাজ্জাক ভাই চলচ্চিত্রে আসেন জহির রায়হানের হাত ধরে। আমিও চলচ্চিত্রে আসি জহির ভাইয়ের সিনেমার মাধ্যমেই। প্রথম চলচ্চিত্র ‘সংসার’-এ রাজ্জাক ভাই ছিলেন আমার বাবা। আর সুচন্দা আপু ছিলেন আমার মা চরিত্রে। এরপর ‘শেষ পর্যন্ত’ চলচ্চিত্রে আমি ছিলাম রাজ্জাক ভাইয়ের নায়িকা। তিনি সবসময় চলচ্চিত্রের সবার ছায়া হয়ে থাকতেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ‘রাজ্জাক’ যেমন একটি উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, আমার জীবনেও রাজ্জাক ভাই তেমন। তিনি ছিলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় অভিভাবক। তাঁর প্রয়াণ মানে চলচ্চিত্র জগৎ ও এ জগতের সবার জন্য অসীম শূন্যতা, যা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ছিলেন ফিলোসোফার, গাইড দেওয়ার মতো লোক। তাঁর মতো এমন কেউ আর আসবেন না। আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তারপরও রাজ্জাক ভাই নেই এ কথা কখনো বিশ্বাস করতে চাই না। তিনি আছেন আমাদের হৃদয়জুড়ে, প্রতি মুহূর্তে সবার নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে। চিরদিন তাই থাকবেন।
নায়করাজের সঙ্গে কাজের কোনো স্মৃতি যা এখনো মনে পড়ে?
রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম চলচ্চিত্র ‘সংসার’-এ আমি তাঁর মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করি। এর দুই বছর পর তাঁর নায়িকা মানে ছবিতে তাঁর প্রেমিকা চরিত্রে আমাকে অভিনয় করতে হবে। ছবির নাম ‘শেষ পর্যন্ত’। আমি তো ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। আগের ছবিতে যে ছিলেন আমার বাবা তাঁর সঙ্গে এবার প্রেমিকা চরিত্রে অভিনয় করব, তাঁকে এমব্রেস করতে হবে। কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলাম না। তখন জহির রায়হান ভাই ধমক দিলেন আর রাজ্জাক ভাই বললেন, দূর মেয়ে এটি তো অভিনয়। এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে। রাজ্জাক ভাই এমনভাবে বোঝালেন আমার সব জড়তা কেটে গেল। ছবিটিতে আমাদের জুটি দর্শক বিপুলভাবে গ্রহণ করল। এরপর তো তাঁর সঙ্গে আমার সব ছবিই সুপারহিট। আমরা একসঙ্গে প্রায় ৪০টি ছবিতে কাজ করেছি। তাঁর প্রোডাকশন হাউসের প্রথম ছবি ‘অনন্ত প্রেম’ থেকে শুরু করে বেশির ভাগ ছবিতেই আমি নায়িকা ছিলাম।
চলচ্চিত্রের বাইরে নায়করাজকে নিয়ে আপনার মজার কোনো স্মৃতি আছে?
রাজ্জাক ভাইকে ঘিরে অজস্র স্মৃতি রয়েছে আমার। ছোটবেলার একটি স্মৃতির কথা বলি, তখন অনেক ছোট আমি। রাজ্জাক ভাই আমাদের গেন্ডারিয়ার বাসায় সুচন্দা আপুর কাছে আসতেন। তাঁকে দেখলেই লজ্জায় ফ্রিজের ভিতর ঢুকে লুকিয়ে থাকতাম। লুকিয়ে উঁকি দিয়ে তাঁকে দেখতাম। রাজ্জাক ভাই ঠিকই আমাকে দেখে ফেলতেন, আর বলতেন, এই মেয়ে তুমি আমাকে লুকিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছ কেন? পরে যখন তাঁর বাসায় যেতাম তাঁকে আমার লুকিয়ে দেখার বিষয়টি তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিয়ে অনেক হাসতেন।
নায়করাজের পরিবারের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে কী?
অবশ্যই আছে। প্রায় দিনই ফোনে হলেও লক্ষ্মী ভাবীর সঙ্গে কথা হয়। বাপ্পা, সম্রাটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। শুধু তাই নয়, আমেরিকায় রাজ্জাক ভাইয়ের মেজো ছেলে বাপ্পী থাকেন। সেখানে গেলেই বাপ্পী আমার বাসায় ছুটে আসেন। আমি ওর বাসায় গিয়ে কয়েক দিন হলেও থেকে যাই। বাপ্পীর বাচ্চারা ভাবে তাদের দাদুর সঙ্গে আমি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতাম, মানে আমি তাদের আত্মীয়। আসলে রাজ্জাক ভাইকে সবসময় আমার পরিবারের একজন বলেই মনে করি। জহির রায়হান ভাই, সুচন্দা আপু, আমি প্রায় সবসময়ই যে কোনো কাজে একসঙ্গে থাকতাম। মানে আমরা ছিলাম একই পরিবারের সদস্য। রাজ্জাক ভাই না থাকলেও সেই পারিবারিক বন্ধন এখনো অটুট আছে। চিরদিন থাকবে।
শেষ কখন তাঁর সঙ্গে কথা হয়?
রাজ্জাক ভাইয়ের মৃত্যুর কিছ ুদিন আগে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। তাঁকে বলেছিলাম, আমি আপনাকে আজ নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াব। তিনি বললেন- না, আজ নয় আমি ব্যাংকক যাচ্ছি। সেখান থেকে ফিরে তোমার বাসায় যাব। তখন তুমি আমাকে রান্না করে খাওয়াবে। উফ্ (দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে), তাঁকে আর খাওয়াতে পারলাম না। এই কষ্ট কখনো ভুলতে পারব না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর তাঁর জন্য বিশেষভাবে দোয়া করি। সৃষ্টিকর্তা তাঁকে যেন চিরশান্তিতে রাখেন।