আগে একটি সিনেমা ২৫, ৫০, ৭৫ কিংবা ১০০ সপ্তাহ প্রদর্শিত হয়ে মহাসমারোহে নানা জুবিলি পালন হতো। নব্বই দশকের পর থেকে জুবিলি পালন তো দূরের কথা বেশির ভাগ সিনেমা দর্শকের অভাবে এক সপ্তাহও ভালোভাবে হলে প্রদর্শিত হয় না। মানে বেশির ভাগ সিনেমাই ফ্লপের খাতায় নাম লেখায়। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের কথাই যদি ধরি তাহলে দেখা যায় এ সময়ে মোট ২২টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে সত্যিকারের অর্থে হিট হয়েছে মাত্র একটি ছবি। সেটি হলো ‘বরবাদ’। আর চারটি ছবি কোনোভাবে প্রযোজক ও প্রদর্শকের ঘরে অর্থ এনে দিয়েছে। এগুলো হলো- তুফান, দাগি, জংলি, তাণ্ডব ও উৎসব। বাকি ১৭টি সিনেমার ভাগ্যে জুটেছে ফ্লপের তকমা। এগুলো হলো- মধ্যবিত্ত, মেকাপ, কিশোর গ্যাং, রিকশা গার্ল, দায়মুক্তি, বলী, ময়না, জলে জ্বলে তারা, চক্কর ৩০২, জ্বীন ৩, অন্তরাত্মা, জয়া আর শারমিন, আন্তঃনগর, ইনসাফ, এশা মার্ডার : কর্মফল, নীলচক্র এবং টগর। এ তথ্য দিয়েছে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি। কিন্তু কেন সিনেমা ফ্লপ হচ্ছে। চলচ্চিত্র গবেষক ও সিনেমা হল মালিকরা এর কারণ অনুসন্ধান করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে যা বলেছেন তা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
দর্শক প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না
অনুপম হায়াৎ, [সিনিয়র চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক]
দর্শক যেমন সিনেমা দেখতে চায় এখনকার সিনেমা তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না বলেই সিনেমা ফ্লপ করছে। আমাদের এখনকার সিনেমাতে নতুনত্ব বলতে কিছু নেই। বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ্বায়নের যুগে যদি সিনেমায় নতুন এলিমেন্ট যোগ করা না যায় তাহলে দর্শক সেই সিনেমা কেন দেখবে। প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে বর্তমানে মাংসের দোকানে কসাই মাংস কাটতে কাটতে, ঘরে গৃহিণী ভাত রাঁধতে রাঁধতে এমনকি বিভিন্ন অফিসে মিটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে অনেকে মোবাইলে সিনেমা দেখতে থাকে। তা ছাড়া, সামাজিক অস্থিরতা, সিনেমা হল কমে যাওয়া, যানজটের কারণে সিনেমা হলে যাতায়াতে দুর্ভোগ, সিনেপ্লেক্সে টিকিটের উচ্চমূল্য, সিনেমায় অতিমাত্রায় ভায়োলেন্স এমন অনেক কারণে দেশি সিনেমা বিমুখ হয়ে পড়েছে মানুষ। এখন যদি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ও গঠনমূলক ও সুস্থ বিনোদন সমৃদ্ধ সিনেমা নির্মাণ হয় তাহলে সেগুলোই দেখতে মানুষ আগ্রহ দেখায়। এমন সিনেমা তেমনভাবে নির্মাণ হচ্ছে না বলেই দর্শকের অভাবে এখনকার সিনেমা বেশির ভাগই ফ্লপ হচ্ছে।
প্রচারের অভাব রয়েছে
মিয়া আলাউদ্দিন, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট [চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি]
এখন কোনো সিনেমার আর প্রচার হয় না। আগে টিভি, রেডিও, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, ঘোড়ার গাড়ি বা অন্য যানবাহনে ব্যান্ডপার্টিসহ প্রচারণা সিনেমা মুক্তির কয়েক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত। ফলে সহজেই দর্শক আকর্ষণ করত বলে সিনেমা হিট হয়ে যেত। এখনকার শিল্পীদেরও যেন তার সিনেমার প্রতি কোনো মমত্ববোধ নেই। তারা নিজের সিনেমার প্রচারেও এগিয়ে আসে না। তা ছাড়া নির্মাণ, অভিনয়, গল্প গান কোনো কিছুতেই মান থাকে না। আগে একটি সিনেমা নির্মাণ করতে গেলে সেই সিনেমার পুরো টিম আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কাজ করত বলে সিনেমা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মানসম্মত হতো। এখন প্রত্যেকেই নিজেকে অনেক বড় মনে করে বলে সিনেমা আর সিনেমা হয় না। এমন অনেক কারণেই বর্তমান সময়ের সিনেমা ফ্লপের ঘরে চলে যায়।
দর্শক বিরক্ত হতে চায় না
অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম, [ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সিনেমা সম্পাদক ও নির্মাতা]
আমি এখন আর সিনেমা দেখি না, দেখার আগ্রহও বোধ করি না। কারণ কোনো সিনেমাতে ব্যতিক্রম কিছু খুঁজে পাই না। সবই যেন বিনোদনের গতানুগতিক প্যাকেজ। তাই দর্শক একই রকমের প্রোডাক্ট দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে পড়েছে। মানুষ এখন ঘরে বসে নেটে বিশ্বের সব সিনেমা দেখতে পাচ্ছে এবং উচ্ছ্বাস নিয়ে দেখছে। কারণ এসব সিনেমাতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, নির্মাণ, গল্প ও অভিনয় পাচ্ছে। আমার ভাতিজার কথাই বলি, সে ইকোনমিক্সে এমএ তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। সে দেখি নেটে সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমা দেখে। আমি তাকে বলি এসব অ্যাকশনধর্মী সস্তা বিনোদনের সিনেমা কেন দেখ। সে বলে এসব সিনেমা টেকনিক্যাল এবং মেকিংয়ের দিক দিয়ে অনেক উন্নত। বাংলাদেশের এখনকার কোনো সিনেমা এর ধারেকাছেও নেই। আসলে ভেবে দেখলাম আমার ভাতিজার কথায় বেশ যুক্তি আছে। ষাট থেকে কমপক্ষে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত মানুষ সপরিবারে উৎসবের আমেজে সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছে। এটি একটি ঐতিহ্য ছিল বলা যায়। কারণ তখনকার সিনেমা ও এর নির্মাণ, গল্প, গান, অভিনয় সবই ছিল উন্নত মানের, যা সহজেই দর্শক মন কাড়ত। সিনেমা এখন ফ্লপ হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, সিনেমা হলে যাওয়াটা এখন একটা হ্যাসেলে পরিণত হয়েছে। যেমন আগে ঢাকাতেই প্রায় ৪৯টি সিনেমা হল ছিল। বাসার আশপাশেই সিনেমা হল ছিল। তাই সিনেমা হলে যেতে ১০/১৫ মিনিটের বেশি সময় লাগত না। এখন ঢাকায় হাতে গোনা ৪/৫টির মতো সিনেমা হল রয়েছে। ২ থেকে আড়াই ঘণ্টার একটি সিনেমা দেখতে যানজট ঠেলে সিনেমা হলে পৌঁছাতে আরও দুই থেকে তিন ঘণ্টা লেগে যায়। আর সিনেপ্লেক্সে একটি টিকিটের মূল্য ৫০০ টাকার নিচে নয়। এত দাম দিয়ে সবার পক্ষে সিনেমা দেখা কীভাবে সম্ভব? এটি সারা দেশেরই চিত্র। ইয়ং জেনারেশন হচ্ছে সিনেমা হলে বড় অংশের একটি দর্শক। একসময় স্কুল ফাঁকি দিয়ে এই ইয়ং জেনারেশন সিনেমা দেখতে যেত। এখন টিকিটের যে উচ্চমূল্য তাতে তারা সিনেমা দেখতে সেই টাকা পাবে কোথায়? তৃতীয়ত এখন হাতে হাতে মোবাইলে আর ঘরে বসে টিভিতে পছন্দমতো বিশ্বের সেরা সিনেমাগুলো দেখতে পাওয়া যায়। ইয়ং জেনারেশনের মধ্যেও এই অভ্যাস ও চর্চা গড়ে উঠেছে। এখনকার জেনারেশন নেটেই শাকিব, শাহরুখ, আল্লু অর্জুনসহ সব শিল্পীর সিনেমা দেখতে পাচ্ছে। তাই তারা উচ্চমূল্যের টিকিট কিনে, সিনেমা হলে যাওয়ার হ্যাসেল সহ্য করে কেন সিনেমা দেখতে সিনেমা হলে যাবে। এখন সিনেপ্লেক্সে মানুষ যায় ফুড কোর্টে খেতে আর শপিং করতে, এর ফাঁকে সম্ভব হলে সিনেমা দেখে। চতুর্থত এখনকার সব সিনেমার গল্প, অভিনয় আর নির্মাণ প্রায় একই রকম। আমাদের দেশের সিনেমা দেখতে গেলে দেখা যায় এই গল্প বা দৃশ্যটি বলিউড, হলিউড বা সাউথ ইন্ডিয়ান অমুক সিনেমার নকল। বলা যায় আমাদের এখনকার সিনেমা অনুকরণের গোঁজামিলে ভরা। তাই এসব কেন দর্শক দেখবে। সিনেমার গানের ক্ষেত্রেও একই কথা। আগেকার দিনে সিনেমার গান ছিল শ্রুতিমধুর। সহজেই মুখে মুখে ফিরত। কালজয়ী হয়ে আছে সেসব গান। আর এখন ‘লিচুর বাগান’, ‘দুষ্টু কোকিল’, ‘উরা ধুরা’ কিংবা ‘চাঁদ মামা’র মতো সস্তা গান মানুষ কয়দিন বা কীভাবে মনে রাখবে। আগে একটি সিনেমা মানুষ একাধিকবার দেখত। আর এখনকার সিনেমা সেকেন্ড টাইম কেউ দেখার মতো কিছু তাতে খুঁজে পায় না। একবার দেখেই বিরক্ত হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে একটি সিনেমার প্রিমিয়ারে আমাকে আমন্ত্রণ জানালে আমি আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে তা দেখতে যাই। সিনেমাটি শুরুর ১০/১৫ মিনিট পর আমার মেয়ে বলছে বাবা চলো চলে যাই, আমাকে তুমি এটি কী সিনেমা দেখাতে নিয়ে এসেছ? আসলে দর্শক এখন আর বিরক্ত হতে চায় না। তাই সিনেমা হলে এসব সিনেমা দেখতে যায় না। অতএব স্বাভাবিকভাবে সিনেমা ফ্লপের খাতায় নাম লেখায়।