সোমবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

আইয়ুব বাচ্চু আমাদের কষ্টের ফেরিওয়ালা

আলী আফতাব

আইয়ুব বাচ্চু আমাদের কষ্টের ফেরিওয়ালা

আইয়ুব বাচ্চু মানে, আমাদের কাছে একরাশ স্মৃতির মালা। ফিতার ক্যাসেটের মধ্যে কলম ডুকিয়ে ভালো লাগার গানটা বারবার শোনা। কখনো কখনো স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে ওঠা ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ কিংবা ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’। আজ থেকে তিন বছর আগে ২০১৮ সালের এই দিনে ৫৬ বছর বয়সে তিনি শ্রোতাদের কাঁদিয়ে আকাশে উড়াল দিয়েছেন। আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটার থেমে যাওয়ার পর এ দেশের সংগীত-শ্রোতারা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

আইয়ুব বাচ্চুর গানে ‘প্রেম’,  ‘কষ্ট’ ও ‘মৃত্যু’ ব্যাপারটি ঘুরেফিরে ধারাবাহিকভাবে এসেছে। প্রায় চার দশকের দীর্ঘ পেশাদারি সংগীত জীবনে তিনি তাঁর গান দিয়ে দেশের পাড়া-মহল্লার আনাচে-কানাচে কষ্ট ফেরি করে বেড়িয়েছেন। আইয়ুব বাচ্চু আমাদের কষ্টের ফেরিওয়ালা।

কয়েক প্রজন্মকে গানের বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সেই ক্যাসেট-ফিতার কাল পেরিয়ে স্মার্টফোন-ল্যাপটপের যুগে এসেও তাঁর গানের আবেদন কমেনি এতটুকুও। বইয়ের ফাঁকে তাঁর ভিউকার্ড জমানোর সেই উন্মাদনা কখনো কি ভোলা সম্ভব! অটোগ্রাফের জমানা শেষে ফটোগ্রাফের আমলে, বাঙালির চিঠি লেখার অভ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার পর, ই-মেইল, ফেসবুকের কালে প্রবেশের পরও তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি এতটুকুও।

কত লক্ষ-কোটি বিরহী প্রেমিক তারা ভরা রাতে তাঁর গানকে সঙ্গী করেছেন, সে হিসাব কেউ কি জানে? ফেরারি মন নিয়ে নিয়ন আলোয় হেঁটে যাওয়া তরুণ-তরুণীর বড্ড আপনজন ছিলেন বাচ্চু। ইট-পাথরের শহর ঢাকাবাসীকে সুরের মূর্ছনায় ভাসাতে মঞ্চে কেবল আইয়ুব বাচ্চুর উপস্থিতি থাকলেই হতো। কী এক অদ্ভুত মায়া, টান ছিল তাঁর গিটারে! গভীর কোনো বেদনা থেকেই কি অমন বিরহের সুর তুলতেন তিনি! হৃদয় স্পর্শ করে যাওয়া অমন সুরের মোহে আচ্ছাদিত থাকতেন উপস্থিত সবাই। শুধু কি শহর! মফস্বলেও আইয়ুব বাচ্চুর উপস্থিতি মানেই ছিল রোমাঞ্চকর, সারা জীবন মনে রাখার মতো কিছু মুহূর্ত। তবে সবাইকে দুই হাতে আনন্দে বিলিয়ে বেড়ানো আইয়ুব বাচ্চুর সুরের বুকে লুকিয়ে থাকা কান্নার সন্ধান পেয়েছিলেন কজন? সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আকাশে উড়াল দেবেন কেউ কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলেন?

১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের মাটিতে জন্মেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু তথা সবার প্রিয় এবি। তাঁর প্রথম গিটার হাতে নেওয়া, স্টেজে ওঠা, প্রথম ব্যান্ড, গিটার বাজিয়ে প্রথম উপার্জন ৩০ টাকা- প্রথম সবকিছুই চট্টগ্রামে। তাঁর প্রথম গিটার ছিল বাবার দেওয়া। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় পরীক্ষায় ভালো ফল করার বাজিতে জিতে প্রথম একটা গিটারের মালিক হয়েছিলেন। তিনি একজন গিটারিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন ১৯৭৪-৭৫ সালে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে নয়ন মুন্সীকে বাজানো দেখে, সেটি ছিল আজম খানের শো। এটি দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁকেও নয়ন মুন্সীর মতো গিটার বাজানো শিখতে হবে। এরপর নিজে নিজে শেখা শুরু করলেন। অবশ্য একজন বার্মিজ গিটার শিক্ষক ছিলেন তাঁর। তাঁর কাছে অবশ্য তেমন কিছু শিখতে পারেননি, কিন্তু শিখেছিলেন গিটারকে কীভাবে ষোলো আনা ভালোবাসতে হয়। বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে গানবাজনা শুরু করেন ১৯৭৭ সালের দিকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রুডি টমাস, কুমার বিশ্বজিৎ, গুলু, মঙ্গু ও আরও কয়েকজন। ব্যান্ডের নাম দিয়েছিলেন ‘রিদম ৭৭’। তার আগে অবশ্য জ্যাকব ডায়াসের সঙ্গে ‘স্পাইডার’ নামে একটি দলে গিটার বাজাতেন। মূলত, বিয়েবাড়িতে কিংবা হোটেলে ইংরেজি গান কাভার করতেন তাঁরা। তখন আইয়ুব বাচ্চুর নিজের কোনো গিটার ছিল না। অন্তরঙ্গ বন্ধু কুমার বিশ্বজিতের জাপানি টিএসকো গিটার নিয়ে বাজাতেন তিনি। সেটি ছিল ২২ ফ্রেটের লাল-সাদা মেশানো একটি গিটার। এরপর আরেক বন্ধুর কাছ থেকে নেন গিবসন সেমি-অ্যাকুয়েস্টিক গিটার। তার কিছু দিন পর নিলেন ইন্ডিয়ান গিটার রেনল্ডস। তারপর একাধিক জার্মান-আমেরিকান গিটার। এভাবেই চলে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যেই ব্যান্ডের লাইনআপে পরিবর্তন হয় কিছুটা আর তার নাম নতুন করে হয়ে যায় ‘ফিলিংস’।

এরপর ফিলিংসে বাজিয়েছেন বছরদুয়েক। ১৯৮০ সালের দিকে যোগ দেন তখনকার সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যান্ড ‘সোলস’-এ। সে সময় সোলসের দুর্দান্ত লাইনআপ ছিল রীতিমতো ঈর্ষা করার মতো। তপন চৌধুরী, নকীব খানদের আমন্ত্রণে ঢুকে পড়েন নতুন এক সাংগীতিক আবহে। প্রচন্ড পরিশ্রমী ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার নাম ছিল জিমি হেনড্রিক্স, তাঁর ছায়াশিক্ষক। তিনি সান্তানার গিটার বাজানোর স্টাইল শুরুর দিকে ফলো করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করে গিটারকে নিজের আয়ত্তে আনতে চাইতেন। যেহেতু একেবারে নিজের চেষ্টায় তাঁকে গিটার শিখতে হয়েছিল, তাই নিজের সবটুকু দিয়ে অনবরত গিটার বাজিয়ে গেছেন। হোটেলের ছোট একটা রুমে সারা দিন প্র্যাকটিস করতে করতে ঘেমে গিয়ে বাইরের নলকূপের পানি পান করে দিন কেটেছে তাঁর। বেশ কঠিন এক স্ট্রাগল ছিল নিজের মধ্যে। সোলসের সঙ্গে কাজ শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যে সুরকার-কম্পোজার হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু সামনে চলে আসেন মূলত নকীব খান ব্যান্ড ছাড়ার পর। সোলসের প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’-এর পুরোটাই কিন্তু তাঁর বাজানো। আইয়ুব বাচ্চুরা তখন ব্যান্ডসমেত ঢাকায়। ঢাকার বিভিন্ন স্টুডিওতে সেশন গিটারিস্ট হিসেবেও বাজাচ্ছেন তিনি। এরপর আশির দশকের মাঝামাঝিতে আলাউদ্দীন আলীর সহকারী হতে চেয়েছিলেন। আইয়ুব বাচ্চু কিন্তু তখন সুরকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় আছেন। তখন পর্যন্ত তিনি ব্যান্ডে শুধু গিটারই বাজাতেন, কম্পোজ করতেন। মাঝেমধ্যে দুই-একটি ইংরেজি গানের কাভার করতেন, স্টেজে প্রথম গাওয়া বাংলা গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’।

সুরকার হিসেবে নিজেকে আইয়ুব বাচ্চু পুরোপুরি মেলে ধরার সুযোগ পেলেন তপন চৌধুরীর একক অ্যালবামে। একেবারে খাঁটি মেলোডি, সেমি-ক্ল্যাসিকাল গান। অথচ আইয়ুব বাচ্চু পছন্দ করতেন রক, পুরোদস্তুর হার্ডরক। দীর্ঘ ১০ বছরের সোলস অধ্যায়ের ইতিও টেনেছিলেন মেলোডি থেকে রকের দিকে যাত্রা শুরু করার জন্য। সোলস মেলোডিনির্ভর গান করত তখন। কিন্তু বাচ্চু ভালোবাসতেন গিটারের ঝংকার। সোলস থেকে বের হয়ে আসাটাও নতুন কিছু দেওয়ার জন্যই, গিটার শোনাতে হবে বলেই তাঁর গান গাওয়া। সোলসে থাকাকালেই ‘ময়না’ নামে একটি একক অ্যালবাম বের করেছিলেন তিনি। হয়তো এই অ্যালবামের গানগুলো শ্রোতারা ভালোভাবে গ্রহণ করার ফলেই আইয়ুব বাচ্চু গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশের সাহস পেয়েছিলেন। যাঁরা একই সঙ্গে গিটার বাজান এবং সুর করেন, তাঁদের গানে অন্যরকম একটা সুরের আদল পাওয়া যায়, গিটারের মেলোডি ধরা দেয় তাঁদের সৃষ্ট গানে।

এক দশক সোলসে পার করার পর ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল একটি দূতাবাসের ক্লাব কনসার্টে গান করার মাধ্যমে আইয়ুব বাচ্চু তাঁর নিজের ব্যান্ড ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ (এলআরবি) প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য এখানে একটি মজার ব্যাপার ঘটেছিল। তাঁদের ব্যান্ডের নাম ছিল ‘ইয়েলো রিভার ব্যান্ড’ (ওয়াইআরবি)। কনসার্ট করতে গিয়ে দেখেন, সেখানে লেখা ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। এরপর ক্রমাগত নতুন গান, এবির সাফল্য নিয়ে আসে। বছর পাঁচেক পর ব্যান্ডের নাম হয়ে যায় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। এর কারণটা ছিল তাদের আগের নামে একটি ব্যান্ড ছিল অস্ট্রেলিয়ায়। আইয়ুব বাচ্চুর গিটার কালেকশন দেখে পৃথিবীর যে কোনো গিটারিস্ট ঈর্ষান্বিত হবেন। কাছের মানুষদের উপহার, চ্যারিটিতে দেওয়া বাদে অর্ধশতাধিক গিটারের কালেকশন তাঁর। এর মধ্যে কোনোটি আবার দুষ্প্রাপ্য। এসব গিটারের অধিকাংশই সংগ্রহ করা আমেরিকা থেকে। গিটারের এই জাদুকরের স্বপ্ন ছিল ইনস্ট্রুমেন্টাল অ্যালবাম আর কনসার্টের। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাঁর গিটার কনসার্ট হয়েছে, মানুষ শুধু তাঁর গিটার শুনতেই ছুটে গেছেন সেখানে।  তবে আইয়ুব বাচ্চুর সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল একটি গিটার স্কুল প্রতিষ্ঠা করার, যেখানে গিটার ছাড়াও অন্যসব বাদ্যযন্ত্র শেখানো হবে।  কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও এ ব্যাপারে যাঁরা আর্থিক সাহায্য করতে পারেন, তাঁদের সাহায্য তিনি পাননি। এই আক্ষেপ, এই অভিমান এবি বয়ে বেড়িয়েছেন আমৃত্যু।

সর্বশেষ খবর