শনিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

স্মরণে আমাদের গ্যালিলিও

স্মরণে আমাদের গ্যালিলিও

গত বছরের এই দিনে ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বিশিষ্ট নাট্যজন আলী যাকের। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এ দেশের সাংস্কৃতিক বিনির্মাণে তাঁর রয়েছে অসামান্য ভূমিকা।  মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম জন্মদিন পালিত হয় কিছু দিন আগে। আজ আমাদের গ্যালিলিওর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

প্রথম অভিনয়

মঞ্চনাটক ছিল আলী যাকেরের ভালোবাসার প্রথম কর্মক্ষেত্র। একজন অভিনেতা, নির্দেশক ও সংগঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন অসামান্য। তিনি যে কোনো বিষয়েই ছিলেন পারঙ্গম। ১৯৭২ সালের আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। যার প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে। এরপর জুন মাসের দিকে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে। এরপর আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। যার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ওয়াপদা মিলনায়তনে। এর পরের বছর নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের হয়ে তিনি বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটির নির্দেশনা দেন। যেটি ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা। দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনের শুরুটা ছিল ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। সে দিনটি ছিল রবিবার। সারা যাকের প্রথম অভিনয় করেছিলেন সেই নাটকে; সঙ্গে ছিলেন আবুল হায়াত ও আসাদুজ্জামান নূর।

 

ভালোবাসার বন্ধনে

১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন সারা যাকের। একটি নাটক প্রদর্শনীর আগের দিন একজন অভিনেত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে সারা যাকেরকে দেওয়া হয় চরিত্রটিতে অভিনয় করতে। আর আলী যাকেরের ওপর দায়িত্ব পড়ে তাঁকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করার। সারা যাকের খুব দ্রুত চরিত্রটি আয়ত্ত করে ফেলেন। এরপর থেকে দুজনে একসঙ্গে অনেক কাজ করেন। এরই মধ্যে ১৯৭৭ সালে তাঁরা দুজন সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। ফলাফল ভালোবাসার বিয়ে! এই তারকা দম্পতির দুই সন্তান ইরেশ যাকের এবং শ্রিয়া সর্বজয়া। দুজনই মা-বাবার পথ ধরেই হাঁটছেন।

 

শব্দসৈনিক আলী যাকের

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকের। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দসৈনিক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে আলী যাকের সেই স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছিলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করতে বেনাপোল থেকে যশোরের দিকে হাঁটছিলাম। সেই সময় একটি জিপ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ইংরেজিতে চিৎকার করে আমাকে বলছিল, ‘ইউ আর নাউ ফ্রি’, মানে তোমরা এখন মুক্ত, স্বাধীন!’ আমি এই আনন্দের সংবাদ শুনে তৎক্ষণাৎ মাটিতে বসে পড়লাম। তখন বিকাল সাড়ে ৪টা। মনে আছে, আমি এরপর আনন্দে আত্মহারা হয়ে খেতের পাশ দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ি। সেই অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করবার নয়; মুক্ত দেশের সোঁদা মাটির ধূলিকণা ছিল পরম আপন।’

 

আমাদের সেই গ্যালিলিও

সদা হাস্যোজ্জ্বল, নরম-বিনয়ী আর দার্শনিক চরিত্রের মানুষ আলী যাকের। ‘নাগরিক মঞ্চস্থ ‘গ্যালিলিও’ সৃষ্টি না হলে আজকের আলী যাকের হতো না।’- কথাটি এই নাট্যজন বলেছিলেন এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে। ৪৪ বছর বয়সে ‘গ্যালিলিও’তে প্রথম অভিনয় করেছিলেন তিনি। তখন নাটকের গ্যালিলিওর বয়সের চেয়ে তিনি ছিলেন তুলনামূলক তরুণ। তবে ২০১৮ সালের অক্টোবরে সেই মঞ্চ কাঁপানো গ্যালিলিও বেশে দর্শকদের সামনে হাজির হয়েছিলেন। সেটিও ছিল দীর্ঘ ৩০ বছর পর! সেই সময় নাটকের গ্যালিলিওর চেয়েও তাঁর বয়স বেশি ছিল!

 

সবার ভালোবাসার মামা

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকের একটি জনপ্রিয় চরিত্র ছিল ‘মামা’। যেখানে আলী যাকের সেই মামা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এমনকি থিয়েটার মঞ্চে অভিনয়ের সময়ও অনেকে তাঁকে ‘মামা’ বলে ডাকতেন।

 

পেইন্টিং-ফটোগ্রাফি ভালোবাসতেন

আলী যাকের পেইন্টিং ভালোবাসতেন। কোথাও বেড়াতে গেলেই পেইন্টিং কিংবা শোপিস খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসতেন বাসায়। খুবই পছন্দ করতেন নিজের বাড়ি গুছিয়ে রাখতে। বাড়ির ইন্টেরিয়র ডিজাইনও তিনি-সারা ঠিক করতেন। অন্যদিকে আলী যাকের ভালো ফটোগ্রাফি করতে পারতেন। তাঁর তোলা ছবি নিয়ে অনেকবার প্রদর্শনীও হয়েছে।

 

তিনটি প্রিয় চরিত্র

যাঁরা মঞ্চে আলী যাকেরের অভিনয় দেখেছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে স্বীকার করবেন নূরলদীন, দেওয়ান গাজী আর গ্যালিলিও চরিত্রে তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের কথা। এই তিনটি চরিত্রই আলী যাকেরের প্রিয় চরিত্র। আরও একটি চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি। তা হলো, শেকসপিয়রের কিং লিয়ার।  যদিও ব্রেশটের ‘সৎ মানুষের খোঁজে’ নাটকটি ছিল আলী যাকেরের জীবনের একটি বাঁক।

 

কিংবদন্তির স্মৃতিতেবাতিঘর

বনানীর এশিয়াটিক সেন্টারে স্থাপিত হয়েছে আলী যাকেরের স্মৃতি ধরে রাখতে সংগ্রহশালা ‘বাতিঘর’।

 

অভিনেতা আলী যাকের তাঁর অঙ্গনের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয়জন। এই দিনে তাঁকে নিয়ে কথা বলেন সংস্কৃতি অঙ্গনের কিছু গুণী মানুষ।

 

ফেরদৌসী মজুমদার, অভিনেত্রী

টেলিভিশন ও মঞ্চে বেশ কয়েকটি নাটকে আমি তাঁর সহশিল্পী ছিলাম। অভিনয়টা তিনি খুব ভালোবাসতেন। সে জন্য তাঁকে আমি খুব পছন্দ করতাম। সহশিল্পী হিসেবে তিনি আমাকে অনেক উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন। অনেক আগে একবার আমার মস্কো রেডিওতে কাজ করতে যাওয়ার কথা ছিল। আমার বাসায় গিয়ে যাকের বলেছিলেন, ‘আপনি চলে গেলে আমি কার সঙ্গে অভিনয় করব।’ কথাটা এত আন্তরিক ছিল যে, আমি আর যেতে পারিনি। ‘প্রেমপত্র’ নামে একটি আমেরিকান নাটক আমাদের একসঙ্গে করার কথা ছিল। কিন্তু তাঁর শরীর সায় দিচ্ছিল না। তবু তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা শুরু করুন, আমি যোগ দেব।’ কিন্তু তা আর হলো না।

 

আসাদুজ্জামান নূর

আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমরা একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল মঞ্চে গ্যালিলিও নাটকটায় অভিনয় করার। তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল। কলকাতায় আমরা একসঙ্গে নাটক দেখতাম। উদ্বুদ্ধ হয়ে ঠিক করেছিলাম দেশ স্বাধীন হলে আমরাও নাটক করব। তাঁকে আমি একটি রেডিও নাটকে নিয়েছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম, তাঁর ভিতরে অভিনয়ের প্রতিভা আছে। নাগরিকে যোগ দেওয়ার পর দেখা গেল বিজ্ঞাপনী দক্ষতার কারণে দলটির নাটকের চমৎকার প্রচারণা হতো। শুধু নিজের নয়, অন্য দলগুলোর জন্যও সেসব প্রচারণার পথ বাতলে দিয়েছিলেন তিনি।

সত্তরের দশকে আমাদের পাণ্ডুলিপি, নির্দেশক, মঞ্চ কিছুই ছিল না। তার মধ্য দিয়েও বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়ে আমরা যে আধুনিক নাটকের দল করেছিলাম, তিনি ছিলেন সেই কর্মযজ্ঞের এক অগ্রগামী নেতা।

 

তারিক আনাম খান, অভিনেতা

পরিচয়ের পর থেকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে আমরা সম্পৃক্ত ছিলাম। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। সব সময়ই নাটককে এগিয়ে নেওয়ার অনুপ্রেরণা দিতেন। আমাদের দলের ‘নাট্যকেন্দ্র’ নামটি তিনিই দেন। ২০ দিন আগে আমাদের সর্বশেষ দেখা হয়।  বিছানায় শুয়ে সৈয়দ জামিল আহমেদসহ পরিচিত সবার খবর নেন।

নাটক নিয়ে তাঁর স্বপ্নের বার্তা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়াই হবে তাঁকে ভালোবাসার সেরা উপায়।

 

একনজরে

মঞ্চনাটক : কবর, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, বাকি ইতিহাস, বিদগ্ধ রমণীকুল,  তৈল সংকট, এই নিষিদ্ধ পল্লীতে, দেওয়ান গাজীর কিসসা, সৎ মানুষের খোঁজে, অচলায়তন, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, ম্যাকবেথ, টেমপেস্ট, নূরলদীনের সারা জীবন, কবর দিয়ে দাও, গ্যালিলিও।

চলচ্চিত্র : আগামী (১৯৮৬), নদীর নাম মধুমতী (১৯৯৬), লালসালু (২০০১), রাবেয়া (২০০৮)

টেলিভিশন : (ধারাবাহিক) বহুব্রীহি (১৯৮৮), আজ রবিবার (১৯৯৯)। (একক নাটক) একদিন হঠাৎ, নীতু তোমাকে ভালোবাসি, পাথর সময়, অচিনবৃক্ষ, আইসক্রিম, পাণ্ডুলিপি, গনি মিয়ার পাথর।

পুরস্কার : একুশে পদক-১৯৯৯, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদক।

স্ত্রী সন্তান : তাঁর সহধর্মিণী নাট্যজন সারা যাকের এবং দুই সন্তান ইরেশ যাকের, শ্রিয়া সর্বজয়া।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর