মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার : ফেরদৌস ওয়াহিদ

বিখ্যাত মানুষের শূন্যস্থান কখনো পূর্ণ হয় না

বিখ্যাত মানুষের শূন্যস্থান কখনো পূর্ণ হয় না

বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী আজ। বেঁচে থাকলে ৭৪-এ পা রাখতেন। ২০১১ সালের এ দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ‘পপগুরু’ আজম খান। প্রতি বছর এ দিনে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তাঁর পরিবার, বন্ধু-স্বজন, শুভাকাক্সক্ষী, ভক্ত-শিষ্যরা। বিশেষ এই দিনটিতে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন আরেক জনপ্রিয় কিংবদন্তি গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

আজ পপগুরু, মুক্তিযোদ্ধা, প্রয়াত আজম খানের জন্মদিন। একজন সতীর্থ হিসেবে তাঁকে কীভাবে স্মরণ করবেন?

গুরু তো গুরুই। তাঁর শূন্যস্থান কখনো পূর্ণ হওয়ার নয়। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ তাঁর জন্মদিনে প্রথমেই বলতে চাই, তিনি শুধু একজন শিল্পী বা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, একজন সচেতন নাগরিক ও ভালো মানুষও ছিলেন। তাঁকে চাইলেই বোঝা যায় না। অন্তর দিয়ে ভালোবাসলেই শুধু তাঁকে বোঝা যায়।

 

তিনি বেঁচে থাকতে আপনার সঙ্গে তাঁর এমন কোনো সুন্দর মুহূর্ত আছে, যা আজও আপনার অন্তরকে নাড়া দেয়?

এমন অজস্র মুহূর্ত রয়েছে আমাদের। তাঁর সঙ্গে প্রতিটি ক্ষণ ছিল আমার আনন্দময়। তাঁকে ঘিরে আমার জীবনের বড় বেদনা একটাই, সেটি হলো আমার দুর্ভাগ্য। গুরুর মৃত্যুর সময় আমি তাঁর পাশে থাকতে পারিনি। শেষ দেখাটা আর হলো না আমাদের। তখন আমি ওমরাহ হজ পালনে সৌদি আরব ছিলাম।

 

প্রয়াত আজম খানের সঙ্গে আপনার শেষ কথা কী ছিল, তা কি মনে পড়ে?

অবশ্যই মনে পড়ে এবং চিরদিন মনে থাকবে সেই কথা। মৃত্যুর আগে তাঁর সঙ্গে যখন আমার শেষ কথা হয় তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘দোস্ত দেখ বাজারে কিন্তু গানের অবস্থা ভালো না, তুই কিন্তু অভিমান করে সরে যাস না, গেয়ে যাস।’

 

প্রখ্যাত এই পপগুরুর শূন্যস্থান কী পূরণ হওয়ার?

উফ, (দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে) আজম খান চলে গেছেন, তবে একট কথা খুবই বাস্তব, সেটি হলো বিখ্যাত মানুষের শূন্যস্থান কখনো পূর্ণ হয় না। হয়তো কোনো না কোনো সময় নতুন কেউ আসবে কিন্তু আজম খানদের মতো কিংবদন্তি মানুষের শূন্যস্থান শূন্যই রয়ে যাবে।

 

আজম খানের সঙ্গে আপনার পরিচয়ের গল্পটাই শুনি এবার-

১৯৭৩ সালের কথা। তখন ইশতিয়াক, ল্যারি, ইদুসহ বেশ কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একটি গানের দল করেছিলাম। আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তখন শুধু ইংরেজি গান করতাম। তারপরও বাংলা গান গাওয়ার একটা তাগিদ ছিল। সেটা জেনেই আমাদের আরেক বন্ধু শিল্পী ফিরোজ সাঁই এক দিন এসে আমাকে জানায়, তার পরিচিত একটি ছেলে আছে, নাম আজম খান। ভালো গায়। তাকে নিয়ে বাংলা গান করা যেতে পারে। কিন্তু দলের অন্যরা বাংলা গান গাওয়ার পক্ষে ছিল না। তারপরও আমি ফিরোজ সাঁইকে বলি, আজম খানের সঙ্গে দেখা করার কথা। এরপর ফিরোজ সাঁইয়ের মাধ্যমে পরিচয় হয় আজম খানের সঙ্গে। পরিচয়ের প্রথম দিনই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে যায়। তাঁর গায়কিও আমাকে মুগ্ধ করে। তাই গান রেকর্ড করারও পরিকল্পনা শুরু করি।

 

এরপর তাঁর গান নিয়ে তাঁর যাত্রাটা কমন ছিল?

বন্ধু শামীম ও রুমির সঙ্গে ২৫০ টাকা দিয়ে ইন্দিরা রোডের ঢাকা রেকর্ডিং স্টুডিওতে শিফট ভাড়া করি এবং ‘হাই কোর্টের মাজারে’ সেদিন রেকর্ড করা হয়েছিল। আমি রেকর্ড করেছিলাম ‘চাঁদ জাগে তারা জাগে’ ও ‘দুনিয়াটা কত মজার’ গান দুটি। এই গানগুলো শোনার পর স্টুডিওর মালিকের এতটাই ভালো লেগেছিল যে, তিনি আমাদের গান রেকর্ড আকারে প্রকাশ করারও দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সেই গানগুলো সুপারভিশন করে দিলেন আজম খানের বড় ভাই খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক আলম খান। আজম খানের গান দুটি রেকর্ড আকারে প্রকাশের পরপরই দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। জনপ্রিয়তার সেই রেশ ধরেই একসময় আমরা গড়ে তুলি বাংলা পপ গানের ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’। এরপর উচ্চারণের সঙ্গে শুরু হয় নতুন করে পথচলা। যে পথ পাড়ি দিতে গিয়েই আজম খান হয়ে উঠেন তাঁর কালের অনন্য এক শিল্পী। ব্যান্ডের জগতে পেয়েছেন গুরু খ্যাতি। আজম খান চলে গেলেও তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁর কালজয়ী গানের মধ্য দিয়ে।

 

আজম খানকে শিল্পী হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

বন্ধু আর শিল্পী আজম খানের মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যখন সে বন্ধু হিসেবে কাছে থাকত, তখন ভুলে যেত শিল্পী আজম খানের পরিচয়। গল্প-হাসি-আড্ডায় আসর জমিয়ে রাখত। মাঝে মধ্যে ছেলেমানুষিও ভর করত ওর মধ্যে। আজম খান সেই শিল্পী, যাঁকে প্রথম শ্রোতারা গুরু বলে সম্বোধন করা শুরু করেছিল। আজম খান আমাদের দেশসেরা রকস্টার। যে মানুষটিকে নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়, সে অহমবর্জিত জীবন কাটাতে পারত না। বড় মাপের মানুষ হয়তো এমনই।

 

গুরুকে নিয়ে সবশেষে কী বলবেন?

গুরু তো আমাদের একা করে দিয়ে চিরদিনের মতো চলে গেছেন, তবে যতদিন বাঙালি জাতি তাঁকে মনে করবে, মনে রাখবে সেটিই হবে আজম খানের অমরত্ব ও বিশাল প্রাপ্তি। কারণ গুরু তো গুরুই...।

 

আজম খানের জন্মদিন আজ

মুক্তিযোদ্ধা থেকে যেভাবে সংগীত জগতের পপগুরু

মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান মুক্তিযোদ্ধা, সংগীতশিল্পী, অভিনেতা, ক্রিকেটার ও বিজ্ঞাপনের মডেল ছিলেন। তিনি আজম খান নামে সর্বাধিক পরিচিত। তাঁকে বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সংগীতের একজন অগ্রপথিক বা গুরু হিসেবে গণ্য করা হয়।

সত্তরের দশকে গাওয়া একটি গান বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমীদের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের হৃদয় জয় করে নেয়, সেটি হচ্ছে আজম খানের গাওয়া গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। রেললাইনের পাশের বস্তিতে কোনো এক ছেলের মৃত্যুতে তার মায়ের কান্না নাড়া দিয়েছিল আজম খানকে। তা থেকেই এ গানের জন্ম। ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন আজম খান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ঢাকায় বেশ কয়েকটি গেরিলা অভিযানে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের পর গঠন করেন পপ ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে আজম খানের নতুন ঘরানার সংগীত তরুণ প্রজন্মের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।

উল্লেখযোগ্য গান : অভিমানী, আলাল ও দুলাল, দিদিমা, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, ফেলে আসা দিনগুলো পিছু ডাকে, কেউ নাই আমার, আর দেখো না, ব্যস্ত ভবঘুরে, আর গাইবো না গান, থাকবো না যেদিন, রকস্টার, বর্ষাকাল, মাটির পৃথিবীতে, নতুন পুরান, নীল নয়না, কিছু চাওয়া, অনামিকা, পুড়ে যাচ্ছে, গুরু তোমায় সালাম, ওরে সালেকা মালেকা, পাপড়ি কেন বোঝে না, চাঁদকে ভালবেসো না, হাই কোর্টের মাজারে প্রভৃতি

সর্বশেষ খবর