সংগীত যখন শুধু কানে নয়, চোখেও অনুভব করা যায়-তখন বোঝা যায়, সেটি রুনা লায়লার গান। বাংলা আধুনিক গানের উজ্জ্বল নক্ষত্র, উপমহাদেশীয় সংগীতের কণ্ঠশিল্পী, রুনা লায়লা। ক্যারিয়ারে প্রায় ১০ হাজার গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। বাংলা, উর্দু, হিন্দি, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান ও ইংরেজিসহ মোট ১৮টি ভাষায় গেয়েছেন তিনি। তাঁর সুরেলা কণ্ঠ শুধু এপার বাংলায় নয়, ওপার বাংলা, এমনকি পাকিস্তান ও বলিউডেও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। সংগীতে যখন তাঁর ক্যারিয়ার তুঙ্গে, তখন বেশ কিছু প্রস্তাব পেয়েছিলেন এই কণ্ঠশিল্পী, যা যে কোনো শিল্পীর জন্যই সর্বোচ্চ সম্মানের। তাঁকে একসময় বলিউডের রুপালি পর্দায় নায়িকা হিসেবে দেখা যেতে পারত। কিন্তু তিনি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
রাজ কাপুরের নায়িকা হওয়ার আমন্ত্রণ
সে সময়টায় ফোন মানেই ছিল ট্রাঙ্ককল। আর একদিন হঠাৎ অপারেটরের কণ্ঠে ভেসে এলো, ‘ম্যাডাম, আপনার একটা ট্রাঙ্ককল এসেছে... বম্বে থেকে।’ ‘কে ফোন করেছে?’ ‘রাজ কাপুর!’-অপারেটর হাঁপাতে হাঁপাতে জানালেন। নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন রুনা লায়লা। কিংবদন্তি রাজ কাপুর যখন সরাসরি ফোন করে আমন্ত্রণ জানালেন, ‘বম্বেতে আসেন। গান তো গাইবেনই, একটা ছবির আলাপও করব।’ তবে রুনা লায়লা সরলভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ছবিতে অভিনয় করব না, গান হলে যেতে আপত্তি নেই।’ রাজ কাপুর বলেছিলেন, ‘আমার অতিথি হয়ে থাকবেন, বাড়ি বা হোটেল- যেখানে খুশি।’ তবুও সেই সফর আর হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীতে একাধিকবার আমন্ত্রণ পেলেও রুপালি পর্দায় তাঁর প্রতিভার ঝলক দেখেনি বলিউড। তবে গান, সেখানে তাঁর রাজত্ব আজও অমøান।
‘রুনাকে দাও, ফারাক্কা নাও’
ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত সিং, যিনি সাধারণত কারও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন না, একবার রুনা লায়লার কনসার্টে গিয়ে নীরবে সব শুনেছিলেন, দেখেছিলেন। কোনো কথা বলেননি, কোনো বাহবা দেননি, কিন্তু তাঁর নিজের সম্পাদিত ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় যা লিখলেন, তা আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘রুনার গান শুধু শোনার বিষয় নয়, দেখারও বিষয়। আমি বাংলাদেশ সরকারকে শুধু একটি অনুরোধ করতে চাই, আমাদের রুনা লায়লাকে দিন, বিনিময়ে নিন ফারাক্কার সব পানি!’ এ উক্তি দীর্ঘদিন ভুলভাবে শেখ আবদুল্লাহর নামে চালু থাকলেও, রুনা নিজেই পরে তা সংশোধন করেন। তিনি বলেন, ‘না, এটা আবদুল্লাহ সাহেব বলেননি। বলেছিলেন খুশবন্ত সিং। তিনি খুব কমই প্রশংসা করতেন, কিন্তু আমার সেই কনসার্টে এসে সবটুকু মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলেন। তারপরই লিখেছিলেন এই ঐতিহাসিক কথাগুলো।’
‘শের-ই-কাশ্মীর’-খ্যাত রাজনীতিবিদ শেখ আবদুল্লাহর সঙ্গেও একটি বড় ঘটনা রয়েছে। সেখানকার শ্রীনগরে প্রথম হাসপাতাল নির্মাণ করতে একটি কনসার্টে বিনা পারিশ্রমিকে গেয়ে দিয়েছিলেন রুনা লায়লা। তা এখনো ওই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে।
লোভনীয় প্রস্তাব, তবু নিজের মাটি
পাকিস্তানে থাকাকালীন রুনা লায়লা দেশটির চলচ্চিত্র শিল্পে নিজের অবস্থান পাকা করে ফেলেছিলেন। পরিচালক-প্রযোজকরা চেয়েছিলেন, তিনি যেন থেকে যান, আরও কাজ করেন। অভিনয়ের প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে তিনি ফিরলেন, নিজের দেশে, নিজের মাটিতে। ফিরে এলেন শুধু কণ্ঠ নয়, আত্মার টানেই। সব বিদেশি প্রলোভন উপেক্ষা করে তিনি বাংলাদেশকেই করলেন তাঁর শিল্পী জীবনের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
রুনা মানেই সুরের সৌন্দর্য
রুনা লায়লার জীবন কেবল সংগীতের নয়, চেতনারও এক অনন্য অধ্যায়। তিনি প্রমাণ করেছেন, গানের ভুবনে সীমান্ত বলে কিছু নেই, তবে শেকড় থাকতে হয় নিজের মাটিতেই। রাজ কাপুরের মতো কিংবদন্তি তাঁকে সিনেমার পর্দায় চেয়েছিলেন, খুশবন্ত সিং চেয়েছিলেন তাঁকে দেশের সম্পদ বানাতে।
তবুও তিনি থেকে গেছেন আমাদের মাঝে, আমাদের রুনা লায়লা হয়ে।