একজন শিল্পী কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নয়- সবার। বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্র এবং সংগীতের গোড়াপত্তন থেকেই শিল্পীরা মনোযোগী ছিলেন শুধু নিজেদের শিল্পচর্চা নিয়েই। দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে তারা ছিলেন নিরপেক্ষ। কিন্তু সাম্প্রতিককালে শিল্পীরা জড়িয়ে যাচ্ছেন রাজনীতিতে। কেউ এটিকে ব্যবহার করছে সৎ উদ্দেশ্যে আর কেউবা অসৎ। এতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে শোবিজ অঙ্গন। একইসঙ্গে বিভক্ত হয়ে পড়ছে তাদের ভক্তরা। এতে কমছে তারকাদের সর্বজনীন জনপ্রিয়তা।
এ বিষয়ে দেশের গুণী অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে কথা হলে তিনি মন্তব্য করেন, 'শিল্পী হচ্ছে সর্বজনীন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাকে সেই সর্বজনীনতা নষ্ট করা উচিত নয়। এখন আমি যদি রাজনীতির সঙ্গে অর্থাৎ কোনো একটি দলের সঙ্গে যুক্ত হই, তাহলে দেশের ১৬ কোটি মানুষ আমাকে আর ভালোবাসবে না। আমি যে দলের সঙ্গে থাকব শুধু সেই দলেরই সমর্থকরা ভালোবাসবে। অন্যরা দুঃখ পাবে। একজন শিল্পীকে স্বার্থ ছাড়াই সবাই ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। গাড়িতে করে যখন কোথাও যাচ্ছি একজন পুলিশ আমাকে শিল্পী রাজ্জাক বলে সম্মান দিচ্ছে। কিন্তু একজন মন্ত্রীকে যখন পুলিশ সম্মান দেয় তখন তা দায়িত্বের খাতিরেই দেয়। তাই শিল্পীকে এই শ্রদ্ধা ধরে রাখতে হবে। কোনো শিল্পী যখন রাজনীতিতে যেতে চান তখন শিল্পী জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরই যাওয়া উচিত। দেশে-বিদেশে অনেক শিল্পীই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অকালে হারিয়ে গেছে। সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এটা মোটেও উচিত নয়। কারণ শিল্পী হচ্ছে সবার।'
অন্যদিকে গুণীশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী প্রকাশ করেছেন ভিন্নমত। আবদুল হাদী বলেন, 'গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবার আছে, শিল্পীরও তাই। রাজনীতির সঙ্গে একজন শিল্পীর যুক্ত হওয়া এটি তার মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। বিশ্বে এই প্রবণতা রয়েছে। তবে আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে সহনশীলতার অভাব আছে বলেই কেউ একটি দলের সঙ্গে যুক্ত হলে অন্য দলের লোক তাকে মেনে নিতে পারে না। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। আমি যদিও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই কিন্তু যখন ভোট দিতে যাই তখন মার্কা নয় প্রার্থীর আদর্শ, সততা, যোগ্যতা এবং দেশপ্রেমকে প্রাধান্য দিই। আসলে সবার জন্য এটাই হওয়া উচিত।'
তারকাদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে শোবিজ অঙ্গনের বিভিন্ন আড্ডায় নিয়মিত প্রসঙ্গ হয়ে আসছে। এসব আড্ডার মূল বিষয় থাকে, আগে শিল্পীরা শুধু নিজের কাজে মনোযোগী ছিলেন। আমাদের অভিনেতা রাজ্জাক, আলমগীর, সুচন্দা, ববিতা; কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে সুবীর নন্দী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, এন্ড্রু কিশোর, শুভ্রদেবরা কখনো রাজনীতিতে মনোযোগী ছিলেন না। সিনিয়রদের কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে গিয়ে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এখনকার শিল্পীরা এসেই শুরু করেন দলবাজি। এতে শোবিজ অঙ্গনের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
সম্প্রতি কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এভাবে আলোচনা হচ্ছে সবখানে। ন্যান্সির ঘটনাকে সবাই দলবাজির নোংরা প্রদর্শনী হিসেবে দেখছেন। আত্দহত্যার নাটক সাজিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা তৈরি করা। রাজনীতি নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্যকে কেউ ভালো চোখে দেখছেন না। এর আগে ফেসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাস নিয়ে আলোচনায় আসতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু স্ট্যাটাসের উপস্থাপনভঙ্গি এবং শব্দের ব্যবহার অশৈল্পিক এবং রুচিহীন ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি আলোচনায় আসতে একের পর এক গল্প বানিয়েছেন। এসব ঘটনাকে সাধারণ শিল্পীরা তো বটেই তার ঘনিষ্ঠজনরাও একজন শিল্পীর অশৈল্পিক কাণ্ড হিসেবে মনে করছেন।
সম্প্রতি সবখানে আরও একটি বিষয় আলোচিত- আগে শিল্পীরা সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতেন। কিন্তু এখন যুক্ত হচ্ছেন রাজনীতিতে। আর এ সুযোগে তারকাদের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করতে রাজনৈতিক দলগুলো তারকাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক তারকা আবার ব্যক্তিগত আদর্শের কারণে স্বেচ্ছায় রাজনীতি করেন। আমাদের দেশে বিনোদন জগতের তারকা থেকে রাজনীতিবিদ- এ তালিকায় সর্বাগ্রে রয়েছেন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। বাকের ভাই-খ্যাত তুমুল জনপ্রিয় এই অভিনেতা কর্মগুণে পরপর দুবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তী সময়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী, কণ্ঠশিল্পী মমতাজ ও অভিনেত্রী তারানা হালিম। পাশাপাশি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন এমন তারকাও কম নন। তাদের মধ্যে সোহেল রানা, ফারুক, উজ্জল, ফকির আলমগীর, আনজাম মাসুদ, সোহেল খান, কনক চাঁপা, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, চাষী নজরুল ইসলাম, এটিএম শামসুজ্জামান, ড. এনামুল হক, মনির খান ও আসিফ আকবর উল্লেখযোগ্য।
এখন প্রশ্ন হলো, বিনোদন জগতের এসব তারকা রাজনীতিতে কতটা সফল? সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, 'একজন তারকা রাজনীতি করতে পারবেন না, এটা কোনো সংবিধানে নেই। আর আমি মনে করি একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিই রাজনীতি করার অধিকার রাখেন। কিন্তু আমাদের দেশের তারকা রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটি প্রবণতা দেখা যায়। তারা রাজনীতিতে আসার পর ভুলেই যান, তারা এক সময় বিনোদন জগতের বাসিন্দা ছিলেন। তারা ভাবেন রাজনীতি করলে বুঝি বিনোদন জগতে সব ধরনের কাজ করা যাবে না। কাজ কমিয়ে দেওয়ার কারণে তারা ভক্তদের হারান। সেই প্রভাব তখন রাজনীতিতেও পড়ে। মানুষ ভাবে এসব তারকার বুঝি দিন ফুরিয়ে গেছে। রাজনীতির লোকরাও তখন সুযোগ নেন। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, আমাদের তারকাদের রাজনীতির ভাগ্যে সংসদ সদস্যের চেয়ে বেশি কিছু জোটে না।'