সংগীতশিল্প ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে : গাজী মাজহারুল আনোয়ার
সংগীতের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা অবশ্যই শতভাগ বজায় নেই। কারণ, বাংলা সংস্কৃতির বয়স এখন প্রায় এক হাজার বছর। সত্যিকার অর্থে এই সংস্কৃতির লালন হয়েছে আমাদের দেশেই। দুঃখের বিষয়, আমাদের সমৃদ্ধ এই সংগীতশিল্প বর্তমানে তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে। পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ আর অনুসরণের আগ্রাসনে মৌলিকত্ব হারাচ্ছে। শ্রোতারা এই অবস্থাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। কারণ, আমাদের শ্রোতাদের মধ্যে অধিকাংশই সাধারণ শ্রেণিতে সীমাবদ্ধ। তারা দুর্বোধ্য বা ভিনদেশী কালচারের অনুকরণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে শ্রোতাদের ধারণক্ষমতার দিকে। না হলে এ অবক্ষয় আরও ভয়াবহ হবে।
এখন গানের লিরিকের মধ্যে প্রাণ নেই- এ কথাটাও সত্য। আসলে কবিতা একটি শিল্প। এতে সুর আর কণ্ঠ দিলে গান হয়। কিন্তু আমাদের তথাকথিত আধুনিকতার জোয়ারে গানের কথা বা কবিতা চাপা পড়ে যাচ্ছে। এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। এটি খারাপ নয়। কিন্তু যন্ত্রের মতো গানকে যান্ত্রিক করা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সব কিছুরই লিমিটেশন থাকা দরকার। সীমা অতিক্রম করতে গিয়ে এখন গানে আর প্রাণের ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
চলচ্চিত্রের গল্প টেনে নিতে গানের প্রয়োজন। কারণ, দীর্ঘ সময় ধরে গল্প দেখতে দেখতে দর্শক যখন ঝিমিয়ে পড়ে তখন গানের প্রয়োজন। দর্শক একটু রিল্যাঙ্ ফিল করে। তবে গল্প আর সিকোয়েন্সের প্রয়োজনেই চলচ্চিত্রে গানের আয়োজন হয়। ষাট, সত্তর, আশির দশকে নির্মাতারা গান নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করত। গানের কারণে সিকোয়েন্স হতো। এখন বলা হয় সিচিউশনের জন্য গান দরকার। এটি আসলেই অবক্ষয়। এখন লেখা, সুর দেওয়া, গাওয়া যার যার মতো করে চলছে।
জীবনবোধ ভিতরে লালন করতে হয় : শহীদুল্লাহ ফরায়েজী
সংগীত হচ্ছে আত্দার খোরাক। ইহজগৎ ও পরজগতের মধ্যস্থতাকারী সেতু। সুতরাং মানুষের ভিতর যত দিন আত্দা ও হৃদয় থাকবে ততদিন সংগীত থাকবে। সংগীতের রস আহরণ করে অমরত্ব লাভ করে মানুষ। কিন্তু পরিবর্তনশীল রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার কারণে সংগীতের পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু ঐতিহ্য হারাতে পারে না। এই ঐতিহ্য নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। কারণ, সংগীতেই সংগীতের প্রাণ আর ঐতিহ্য নিহিত। স্টাইলে পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু নিত্যনতুন হৃদয় অনুসন্ধান করে অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য আবিষ্কার করাই মানুষের ধর্ম। এই পরিবর্তনে হতাশার কিছু নেই। জীবনবোধকে ভিতরে লালন করতে হয়। জীবনের প্রাচুর্য এবং মহামান্বিত দিককে অনুসন্ধান করতে হয়। সত্যের কাছে অবস্থান করলে গানের মাঝে প্রাণের ছোঁয়া আসবে। যে গানে জীবনের নৈতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে না, পরম সুন্দরের দিকে ধাবিত হওয়ার শক্তি দেয় না, আত্দিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার ক্ষমতা দেয় না- সেই গান অবশ্যই হারিয়ে যাবে। গানকে হৃদয় এবং আত্দার সঙ্গে সংযুক্ত করে রচনা করতে হবে।
চলচ্চিত্রের গানকে আরও জীবনমুখী ও নৈতিকতামুখী করতে হবে। গল্পের সঙ্গে মাখামাখি পূর্ণ হতে হবে। না হলে এ গান মানুষের হৃদয়কে তাড়িত করতে পারবে না।
পড়াশোনার বিকল্প নেই :মুনশী ওয়াদুদ
সত্যি বলতে একসময় সংগীতের যে চেহারা আমরা দেখেছি তা এখন আর নেই। তখন গান লেখা, সুর দেওয়া আর কণ্ঠে যে ভালোবাসা আর আবেগ ছিল তা এখন কোথায়? এখন যন্ত্রের দাপটে গান আর হৃদয় ছুঁতে পারে না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এখনকার গানে কাব্যময়তা, ছন্দ, অন্তঃমিলসহ আনুষঙ্গিক কিছুই নেই। অন্যদিকে গান করতে গেলে পড়াশোনার বিকল্প নেই, তবে পুঁথিগত বিদ্যা নয়। আক্ষরিক অর্থে গানকে অন্তরে ধারণ করতে হবে। এখন এসব নেই বলেই আগের গান শুনলে এখনো নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই আর এখনকার গানে বিরক্তি আসে।
গান আর শিল্পী দুরন্ত ঘোড়ার মতো ছুটছে : মিল্টন খন্দকার
আসলেই গান এখন আর ঐতিহ্যের ধারায় নেই। এখন যারা গায় তারা ঐতিহ্যের ধার ধারে না, গাওয়ার জন্য গায়। অল্প বয়সে গান করছে। অর্থ কড়িই এতে মুখ্য হয়ে উঠছে। এ ঐতিহ্যের জন্য বয়স, বুদ্ধি আর দেশপ্রেম সম্পর্কে বোঝার ক্ষমতা থাকতে হবে। গান এখন দ্রুত বের হয়, গান আর শিল্পী যেন দুরন্ত ঘোড়ার মতো ছুটছে। কিন্তু কেন, কোথায়, কীভাবে ছুটছে তা কারও জানা নেই। আগের চলচ্চিত্রে গল্পের প্রয়োজনে গান হতো। আর এখন গানের প্রয়োজনে চলচ্চিত্র হয়। এই অবস্থার জন্যই এখন চলচ্চিত্রের গানে প্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
নতুন প্রজন্ম গানের গ্রামার অনুসরণ করছে না : কবির বকুল
আসলে শেকড়ের টানে গান বেঁচে থাকে। অতীত ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই কোনো কিছুর সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। গানের ক্ষেত্রেও তাই। ফলে সমৃদ্ধ অতীতকে লালন করেই আমরা গান নিয়ে এগোচ্ছি। শত ঝড়-ঝঞ্ঝা সত্ত্বেও অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করেই আমাদের এগোতে হবে।
এখন দুটি কারণে গানের প্রাণ হারাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে যারা লিখছেন অনেকেই অপরিপক্ব। ছন্দ, অন্তঃমিল তারা বোঝে না। নিজস্ব ঢঙের অভাবে সেই গান প্রাণ ছোঁয় না। আসলে নতুন প্রজন্ম গানের গ্রামার অনুসরণ করে না বলেই এই দুর্বলতা এখনকার গানে প্রকট হচ্ছে।
চলচ্চিত্রের গানে এখনো প্রাণ আছে। বছরে যতগুলো গান হিট হয় এর প্রায় সবই চলচ্চিত্রের গান। তাই আগের মতো চলচ্চিত্রের গান এখন আর হিট হয় না বা সাড়া জাগায় না এ কথা মানতে আমি রাজি নই। একসময় শুধু এ দেশের ছবি দেখত বলে এর প্রতি দর্শক-শ্রোতার আকর্ষণ বেশি ছিল। এখন নানা দেশের ছবি দেখছে। তাই গানের আকর্ষণও ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ফলে মনে হচ্ছে আমাদের চলচ্চিত্রের গান আগের মতো সাড়া জাগাতে পারছে না।