চিরতরে চোখের দুয়ার বন্ধ হলো এই তল্লাটের সবচেয়ে বড় নজরুল সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের। এই চোখ কাজী নজরুল ইসলামকে দেখা চোখ, এই চোখ সংগীতের একটা ঐতিহ্য বয়ে বেড়ানো চোখ। সেই চোখের দুয়ার বন্ধ! সংগীতপ্রেমীদের জীবনে এর থেকে দুঃখের সময় আর কি হতে পারে!
ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে কাজী নজরুল ইসলামের গানের পাখি বুলবুলি। কিন্তু তিনি কি বিদায় বেলায় আবার গেয়ে গেলেন- 'আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমাকে দিবা না ভুলিতে...'। তিনি গানটি মনে মনে আওড়ান কিংবা না আওড়ান, ভক্তকুলের মন কখনো ভুলবে তাকে।
ফিরোজা বেগমের জন্ম ১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই ফরিদপুরের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। তার বাবার নাম খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল এবং মায়ের নাম বেগম কওকাবুন্নেসা। ছোটবেলা থেকেই ফিরোজা বেগম বুঝিয়ে দেন, তিনি সংগীতের এক বিস্ময়-বালিকা। ১০-১১ বছর বয়সে তিনি যে শক্ত সুরে গাইতেন তা বিস্ময় ছাড়া আর কিছু না। তাই মাত্র ১১ বছর বয়সে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যে দুটি গান শোনালেন, তা শুনে অবাক হন সবাই।
ফিরোজা বেগম গানের সঙ্গেই বসবাস করেছেন সারাটা জীবন। যিনি জন্ম থেকেই গানের সঙ্গে করেছেন বন্ধুত্ব। তাই গান অনুরাগী হয়ে ১৯৫৫ সালে সুরকার কমল দাশগুপ্তকে বিয়ে করেন। এরপর সংসার আর গান। একটি আরেকটির পরিপূরক হয়ে ওঠে।
১৯৪২ সালে ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ইসলামী গান নিয়ে তার প্রথম রেকর্ড বের হয়। কিছুদিন পর কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড হয়। এ রেকর্ডের গান ছিল- 'ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ' আর 'প্রীত শিখানে আয়া'। নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত তার প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৪৯ সালে।
১৯৭২ সালে কলকাতায় বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলন-মঞ্চে কমল দাশগুপ্তের ছাত্রী ও সহধর্মিণী হিসেবে তিনি ছিলেন মুখ্যশিল্পী। উভয়ের দ্বৈতসংগীত সব শ্রোতা-দর্শককে ব্যাপকভাবে বিমোহিত করেছিল।
ফিরোজা বেগমকে গানের জন্য সম্মাননা জানানো কঠিন। তার তুলনা শুধু তিনি নিজে। কিছু কিছু মানুষকে সম্মাননা জানিয়েও সত্যিকার সম্মান প্রকাশ করা যায় না। তবুও তার বাসায় সংগ্রহে আছে অজস্র পুরস্কার। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি স্বর্ণপদক, সেরা নজরুল সংগীতশিল্পী পুরস্কার [টানা বেশ কয়েকবার], নজরুল আকাদেমি পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট, এমন আরও অগণন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও জাপানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিবিএস থেকে পেয়েছেন গোল্ড ডিস্কসহ প্রভৃতি পুরস্কার। ২০১২ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে 'বঙ্গ সম্মান' পুরস্কারটি গ্রহণ করেন।
এই অর্জনের থেকেও বড় অর্জন মানুষের মন জয়। তাই কাঁদছে সংগীতপ্রেমীরা।