সেই কোন ছোটবেলা থেকে তাকে চিনি। স্নেহে-ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়।
আমার বাবা হরিহর শুক্লার সঙ্গে বহু দিনের যোগাযোগ ছিল ফিরোজা বেগমের। আসলে বাবার সংগীত জীবনের প্রথম দিকের বেশির ভাগ গানই কমল দাশগুপ্তের সুরে। ফিরোজা বেগমের সঙ্গে কমলবাবুর বিয়ের পরে তারা জোড়ায় আসতেন শ্যামবাজারে বাবার গানের স্কুলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত গল্পে-গানে।
আমি তখন খুব ছোট। তবু তার মধ্যেই মনে করতে পারি ফিরোজা বেগম নামে বড্ড শৌখিন এক মানুষকে। সোনার কাজ করা শাড়ি পরে এসে বসতেন। তারা চলে যাওয়ার পর গানের স্কুলের সকলে মিলে বসার জায়গাটা ঝেড়েঝুড়ে দেখত। তার শাড়ি থেকে ঝরে পড়া সোনার কুঁচি পড়ে নেই তো! আর কমল দাশগুপ্ত ছিলেন খুব সাদাসিধে। আমাদের সঙ্গে গল্প করে যেতেন খোলা মনে।
বড় হয়েও তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হইনি একটুও। বাংলাদেশে তার ভাইয়ের সুরে আমায় গান গাইতে বলা কিংবা নিজের অনুষ্ঠানে গাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, সব সময়ই দুহাত ভরে দিয়ে গিয়েছেন।
আর তার গান? মনে হতো গানের কথাগুলো যেন তার নিজেরই কথা। বড্ড ভিতর থেকে গাইতেন। ডুবে যেতেন সুরে। শিল্পী মানুষ ঠিক যতটা সৌরভ ছড়িয়ে দেন চারপাশে, ভিড়ের মধ্যে ঠিক যেভাবে আলাদা করে চেনা যায়, ফিরোজা বেগম ঠিক তেমনই। আজকালকার শিল্পীদের মধ্যে সেটাই যেন আর খুঁজে পাই না সেভাবে। কমল দাশগুপ্তের সুরে তার অমর গানগুলো মনে থাকবে। মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যাবেলা, আজও কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া, দূর দ্বীপবাসিনী, রুমঝুম রুমঝুম... কত যে গান মনের মধ্যে গেঁথে আছে। থাকবে চিরকাল।
সবাই একদিন চলে যান। পড়ে থাকে শূন্যতা। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আল্লারাখা, নৌশাদজি, ফিরোজা বেগম- কত বড় বড় শিল্পীর সান্নিধ্যে এসেছি। সবাই একে একে চলে যাচ্ছেন। মাথার ওপর ছাদটা কেমন যেন ফুটো ফুটো হয়ে যাচ্ছে।