নিঝুমপাড়ায় ঝিমিয়ে পড়েছে পঞ্চগড়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। দিবসভিত্তিক সরকারি কিছু অনুষ্ঠানে সরকারি দলের আজ্ঞাবহ শিল্পীদের বাঁধাধরা এবং পুরনো কিছু পরিবেশনা ছাড়া অনেক দিন ধরে ব্যতিক্রম কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন বা চর্চা পঞ্চগড়বাসী উপভোগ করছে না। এর পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, তরুণ প্রজন্মের অনাগ্রহ, গণমাধ্যমের প্রচারহীনতা, শিল্পীসমাজের গ্রুপিংসহ নানা কারণ তুলে ধরেছেন পঞ্চগড়ের শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও নির্দেশকরা।
সাহিত্য, নাটক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রায় অর্ধশতাধিক সংগঠন থাকলেও হাতে গোনা দু-একটি ছাড়া বাকি কটি নামসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। অনেক সংগঠন নাম লিখিয়েছে বিলুপ্তির পাতায়। পঞ্চগড়ে এখনো গড়ে ওঠেনি কোনো মানসম্পন্ন গানের স্কুল। পাঁচ বছর আগে 'কারিগর' নামে একটি থিয়েটার স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলেও পৃষ্ঠপোষকতা আর শিক্ষার্থীর অভাবে তা-ও কোনোরকমে চলছে।
কার্যক্রম না থাকায় 'পঞ্চগড় জেলা নাট্য সমিতি'র সদস্যপদ বাতিল করেছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান। আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত এ নাট্যদলটি এক দশক ধরে নতুন কোনো প্রযোজনা মঞ্চে আনতে পারেনি। দলটির সভাপতি মিজানুর রহমান জানান, বয়সের ভারে সদস্যরা কাজ করতে পারছেন না। নতুনরাও মঞ্চের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে না।
'বহুভুজ সাহিত্য পরিষদ'-এর সভাপতি পঞ্চগড় মহিলা কলেজের ইতিহাস বিষয়ের শিক্ষক আলী ছায়েদ বলেন, এখানে কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। অন্যদিকে, তরুণরা রাজনীতিতে যতটা আগ্রহী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভূমিকা রাখতে পারত, কিন্তু তা-ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলছে। সেখানে মূলধারার কোনো শিল্পী-সাহিত্যিক যান বলে মনে হয় না।
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম বলেন, তরুণদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কমে যাওয়া এবং টেলিভিশন ও সিনেমা নির্ভর হয়ে ওঠা জেলার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ার একটি কারণ। এ ক্ষেত্রে শিল্পকলা একাডেমি ভূমিকা রাখতে পারলেও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাহিত্যনির্ভর নাটক নির্মাণ উৎসবে ঢাকা থেকে একজন নির্দেশক পাঠানো হয়। অথচ নীতিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে- নিজ নিজ জেলার নির্দেশকরা ওই নাটকটি নির্মাণ করবেন। এ নিয়ে স্থানীয় নাট্যকর্মীরা লিখিত প্রতিবাদ জানালেও পঞ্চগড় শিল্পকলা একাডেমি কোনো ভূমিকা নেয়নি। পঞ্চগড় শিল্পকলা একাডেমিতে নাট্য বিভাগ ছাড়া সব বিষয়ে শিক্ষক থাকলেও ছাত্রছাত্রী ভর্তি বা নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না। তৎকালীন জেলা প্রশাসক নাট্য বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দিলেও একাডেমির সাধারণ সম্পাদকের অবহেলায় এ পদটি সাত বছর ধরে শূন্য রয়েছে বলে অনেক নাট্যকর্মী জানান।
শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক আবু তোয়াবুর রহমান জানান, সব কার্যক্রমই ঠিকঠাক চলছে। তবে পঞ্চগড়ের শিল্পাঙ্গন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে এ কথা সত্য। শীঘ্রই নাট্য প্রশিক্ষক এবং আরও কয়েকটি বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হবে। 'ভূমিজ নাট্য গোষ্ঠী'র সহ-সভাপতি নাট্যকর্মী আবু হাজ্জাজ তানিন বলেন, একেবারেই ঘুমিয়ে পড়েছে এ কথা ঠিক নয়। ভূমিজ প্রতি বছর ছোট-বড় মিলিয়ে কমপক্ষে দুটি নতুন মৌলিক নাটক মঞ্চে আনছে। সিনেমা উৎসব, বসন্ত উৎসব, পায়ে হাঁটা উৎসবসহ নানা ধরনের আয়োজন করছে। এ বছর জাতীয় নাট্যোৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে পঞ্চগড়ে অনেক সম্ভাবনাময় শিল্পী, অভিনেতা আছেন। তারা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পড়ে আছেন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্রচার কেবল ঢাকামুখী। ঢাকায় একজন যেমন-তেমন মানের শিল্পীও গণমাধ্যমের প্রচারগুণে তারকা হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের এগিয়ে আসা উচিত। পঞ্চগড় শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, 'আমরা সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু কেউ এগিয়ে না এলে কেমন করে হবে। শিল্পকলা একাডেমিতে একটি কমিটি আছে। সাধারণ সম্পাদক তৎপর নন।'