একটা সময় ছিল যখন গানের অ্যালবাম প্রকাশ করা মানেই ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। শ্রোতারা অপেক্ষায় থাকত কখন তাদের প্রিয় শিল্পীর গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হবে। সিডি ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতেন পছন্দের শিল্পীর গানের অ্যালবাম কেনার জন্য। দেশীয় সংগীত ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ক্যাসেট মাধ্যমটি। বিশেষ করে নব্বই দশকে বিভিন্ন রঙবেরঙের মোড়কের কভার-ক্যাসেটে গান শোনার মাধ্যমে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ব্যবসা সফলতার দিক দিয়ে সর্বোচ্চ অবস্থানে দাঁড় হয়েছিল। শূন্য দশকের শুরুতে সাউন্ডটেক থেকে ক্যাসেট মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া আসিফ আকবরের 'ও প্রিয়া তুমি কোথায়' ৬০ লাখ কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছিল। ২০০৪ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করে সিডি মাধ্যম। সিডি-ভিসিডির প্রভাবে ক্যাসেট মাধ্যম হারিয়ে যায় দুই বছরের মধ্যে। অডিও কোম্পানিগুলো সিডির মাধ্যমে প্রকাশ করতে থাকে বিভিন্ন শিল্পীর গান। তবে ততদিনে আবার পাইরেসি এবং পরবর্তীতে ইন্টারনেটে ফ্রি ডাউনলোডের ফলে পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে পড়ে অডিও তথা সংগীত ইন্ডাস্ট্রি। প্রযুক্তির প্রভাবে গত দুই বছরে সারা দেশে বন্ধ হয়েছে প্রায় ৬০০ সিডির দোকান। যার ফলে ক্যাসেটের পর এবার পুরোপুরি ধ্বংস ও বিলুপ্তির পথে সিডি মাধ্যম। প্রযুক্তির কুফল এটা। কিন্তু কুফলের এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে এখন আবার দেখা যাচ্ছে নতুন দিগন্তের হাতছানি। যেই প্রযুক্তি কুফল ডেকে এনেছে, সেই প্রযুক্তির কাঁধেই ভর করে সুফল আসবে। শিল্পীরা এখন ঝুঁকছেন অনলাইনে অ্যালবাম রিলিজ প্রথার দিকে। গত দু-তিন বছরেই অনলাইনে অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন দেশের অনেক গুণী শিল্পী। ২০১৫ সালটিকে তাই ডিজিটাল গান প্রকাশের যুগান্তকারী বছর হিসেবেও মনে করছেন সংগীতবোদ্ধারা। এভাবে গান প্রকাশে সবচেয়ে লাভবান হবেন শিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সংগীত পরিচালকরা। কারণ, এই নিয়মে গান প্রকাশ করলেও সম্পূর্ণ গানের স্বত্ব নিজের কাছেই রাখতে পারছেন সংগীত সংশ্লিষ্টরা। ওয়েলকাম টিউন, রিংটোন থেকে অর্জিত আয়ের সঠিক হিসাবটাও নিজেরাই রাখতে পারছেন। পাশাপাশি অনলাইনে আন্তর্জাতিকভাবেও নিজেদের অ্যালবাম প্রকাশ ও নির্দিষ্ট মূল্যে বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন তারা। এখানে ফ্রি ডাইনলোডেরও কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশে কাজ শুরু করেছে কাইনেটিক, জিরোনার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। অডিওর বাইরে ভিডিওর মাধ্যমেও এক্ষেত্রে একটি আয়ের দ্বার উন্মোচিত এরই মধ্যে হয়েছে। সব মিলিয়ে এই অনলাইনে গান প্রকাশের বিষয়টিকে সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম হিসেবে মনে করছেন শিল্পীরা। তবে অনেকেই এসব বিষয় সম্পর্কে অবগত নন। ডিজিটালি গান প্রকাশনার বিষয়ে শিল্পী ও সংগীত সংশ্লিষ্টরা যতটা সচেতন হবেন ততটাই ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা ভালো হবে বলে মনে করছেন সংগীতবোদ্ধারা। শিল্পী তখনই ভালো কাজ করার আগ্রহ পান যখন সেই কাজটি তাকে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেয়। অডিও অঙ্গন এখন যে সময় পার করছে তাতে শিল্পীদের নিশ্চিন্তে কাজ করার পরিবেশ নেই। তবে এই দুঃসময় শেষের পথে বলে মনে করছেন অনেকে। তাদের বিশ্বাস মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি তথা শিল্পীরা আবারও ফিরে পেতে যাচ্ছেন হারানো সেই স্বর্ণযুগ। এমনটি যদি হয়েই থাকে তবে তা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকেই এগিয়ে দেবে। কারণ শিল্পী বাঁচলেই সংস্কৃতি বাঁচবে।
অনলাইনে গান প্রকাশ প্রসঙ্গে শিল্পী আসিফ আকবর বলেন, 'প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। বিশ্ব এগিয়ে গেছে। তাই আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে।' হাবিব ওয়াহিদ বলেন, 'যে কোনো বিষয়ের ভালো-মন্দ দিক আছে। আমরা প্রযুক্তির মন্দ দিকটার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন ভালো দিকটা ব্যবহার করে উপকৃত হতে হবে।'
শুধু আসিফ কিংবা হাবিব নয়, বেশির ভাগ শিল্পীই এখন অনলাইলেন অ্যালবাম প্রকাশের পক্ষে। হয়তো এভাবেই আবার জেগে উঠবে আমাদের সংগীতাঙ্গন।