ষাট থেকে নব্বই দশকের প্রথমভাগ পর্যন্ত ছিল দেশীয় চলচ্চিত্রের গৌরবময় সোনালি অধ্যায়। এরপর নানা প্রতিকূলতায় এই ঐতিহ্য হারাতে থাকে। মৌলিক গল্প ও চিত্রনাট্যের অভাব, নির্মাতা ও শিল্পী সংকট, অশ্লীলতা, পাইরেসি, অবাধ আকাশ সংস্কৃতি একে একে গ্রাস করে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে। এই অচলাবস্থা থেকে চলচ্চিত্রকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়। এ বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। তাদের মতামত তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
রাজ্জাক
মৌলিক গল্প ও চিত্রনাট্য নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। নির্মাতাদের নকল প্রবণতা পরিহার করতে হবে। তাছাড়া চলচ্চিত্র নির্মাণে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। প্রকৃত বাজেট নিশ্চিত করা দরকার। শিল্পীদের মধ্যে অভিনয় জ্ঞান ও পরিশ্রমের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এফডিসি ও সিনেমা হলকে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে।
চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে ঐক্য থাকতে হবে। সরকারি অনুদানের অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। এফডিসিকে সত্যিকারের চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হবে। এফডিসি শুধু ফ্লোর ও ডাবিং-এডিটিং থিয়েটার ভাড়া দেওয়া নয়, এখানে উন্নত চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কর্মশালা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করতে হবে। এফডিসির প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। অর্থাৎ চলচ্চিত্রের উন্নয়নে যথার্থ ভূমিকা রাখতে হবে এফডিসিকে।
আমজাদ হোসেন
যত্ন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে ও মৌলিক গল্পকে প্রাধান্য দিতে হবে। সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। দর্শকের কাছে গল্প উপস্থাপনে তাদের রুচিকে প্রাধান্য দিতে হবে। নকল ও উদ্ভট গল্প পরিহার করতে হবে। তাছাড়া ডিজিটাল পদ্ধতি সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জন করতে হবে। গল্প থেকে শুরু করে এডিটিং প্যানেলের সবাইকে ডিজিটাল পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। সিনেমা হলগুলোতে টু কে ইফেক্টের প্রজেক্টর স্থাপন করতে হবে। এফডিসিকে ডিজিটাল প্রযুক্তির চলচ্চিত্র নির্মাণে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও অভিনয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং এ বিষয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের নিয়মিত আয়োজন ছাড়া চলচ্চিত্রের হারানো ঐতিহ্য ফেরানো সম্ভব নয়। তাছাড়া সেন্সর বোর্ডকে আধুনিক পদ্ধতি মেনে গ্রেড প্রথা চালু করতে হবে। সিনেমা হলের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
ববিতা
এদেশের পারিপার্শ্বিক চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। যাকে বলে মৌলিক গল্পের ছবি। গান হচ্ছে ছবির প্রাণ। গানের মানকে গুরুত্ব দিতে হবে। নাচকে শালীন পর্যায়ে রাখতে হবে। মানে পরিপূর্ণ বাঙালি ঘরানার চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। পরিবার নিয়ে দেখা যায় এমন ছবি নির্মাণ জরুরি। না হলে দর্শক সিনেমা হলে যাবে কেন? বিদেশি ছবির নকল পরিহার করতে হবে। কারণ এটি একটি অবক্ষয়। প্রয়োজনে বিদেশি উন্নত ছবিগুলোর রিমেক করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কপিরাইট নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য ছবি নির্মাণ মানে এই নয় যে, তাতে অযথা অ্যাকশন দৃশ্য ও আইটেম গানের নামে খোলামেলা নাচ থাকতে হবে। দেশীয় গল্পের অনেক ছবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মান কুড়িয়েছে। সেন্সর বোর্ডকে সময় উপযোগী করতে হবে। মানে সেন্সর পরিহার করে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করতে হবে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
নিজ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি লক্ষ্য রেখে জীবনের গল্প বলতে হবে। মানে নকল নয়, আমাদের ঢংয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। আমাদের চার পাশে গল্প বলার আয়োজনের বা ফরমেটের অভাব নেই। তাহলে আমাদের তামিল বা তেলেগু ঢংয়ে গল্প বলতে হবে কেন? আমরা কেন আমাদের ঢংয়ে গল্প বলব না, এ প্রশ্নটি আমাদের নিজেদেরই নিজেদেরকে এখন করতে হবে। কয় বছর আগেও আমাদের চলচ্চিত্রে যে দুরবস্থা ছিল এখন তা কেটে উঠছে।
নতুন প্রযোজনা সংস্থা, নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী এবং নতুন আঙ্গিকের গল্প আসছে এবং ভালো করার চেষ্টা হচ্ছে।
এতে ভালো ফলও পাওয়া যাচ্ছে। ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে এগুচ্ছে আমাদের চলচ্চিত্র। এগিয়ে চলার এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। আমার বিশ্বাস এভাবে এগুলে চলচ্চিত্রের সুদিন পুরোপুরি ফিরবে। তবে হয়তো একটু সময় লাগবে।