এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগ। বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্রে ডিজিটালের ছোঁয়া লেগেছে এক যুগেরও বেশি সময় আগে। এ ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ঢাকায় ১২টি ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রেক্ষাগৃহ থাকলেও দেশের অন্য কোথাও নেই। ফলে এই প্রযুক্তির ছবি নির্মাণ করে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নির্মাতারা পড়ছেন চরম বিপাকে।
এদেশে প্রথম ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ছবি নির্মাণ করেন এম এ জলিল অনন্ত। ২০১০ সালে 'খোঁজ-দ্য সার্চ' ছবিটি প্রযোজনা করেন তিনি। এর পরিচালক ছিলেন ইফতেখার চৌধুরী। দেশের বাইরে থেকে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শেষ করে এখানে ছবিটি মুক্তি দিতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়েন অনন্ত। কারণ দেশে তখন একমাত্র স্টার সিনেপ্লেক্স ছাড়া আর কোনো ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রেক্ষাগৃহ ছিল না। বাধ্য হয়ে ৩৫ মিলিমিটারে ট্রান্সফার করে ছবিটি প্রদর্শন করতে হয় তাকে। এতে ছবিটি দেখতে গিয়ে ডিজিটালের স্বাদ পায়নি দর্শক।
বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে ৩টি ডিজিটাল প্রেক্ষাগৃহ চালু হয় শপিং মলটির প্রতিষ্ঠালগ্নে অর্থাৎ ২০০৪ সালে। ২০১২ সালে সেখানে আরেকটি অত্যাধুনিক থ্রিডি ডিজিটাল থিয়েটার 'স্টার জোন' প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৩ সালে যমুনা ফিউচার পার্কে চালু হয় ৭টি ডিজিটাল প্রেক্ষাগৃহ। প্রায় একই সময় শ্যমলী শপিং মলে খোলা হয় একটি ডিজিটাল হল। ঢাকায় এখন এই ১২টি ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। দেশের আর কোথাও নেই।
২০১২ সালে চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী আবদুল আজিজ তার প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে ডিজিটাল প্রজেক্টর স্থাপন শুরু করে। এই সংখ্যা এখন প্রায় ১৮০টি। অচিরেই তারা আরও অর্ধশতাধিক প্রেক্ষাগৃহে এই প্রজেক্টর স্থাপনের কথা জানায়। চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলছেন, এই ব্যবস্থা অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। কারণ ভিডিও প্রজেক্টর স্থাপন করেছে জাজ। মুভি প্রজেক্টর নয়। এতে প্রকৃত ডিজিটাল মুভি উপভোগের সুবিধা নেই। এগুলোকে ডিজিটাল প্রেক্ষাগৃহ বলা যায় না। তা ছাড়া ছবি প্রদর্শন করতে গিয়ে প্রতি সপ্তাহে জাজকে মেশিনের ভাড়া দিতে হয় প্রযোজককে। অথচ এই ভাড়া পরিশোধের কথা প্রেক্ষাগৃহ মালিক-প্রদর্শকের। এতে একদিকে প্রকৃত ডিজিটাল ছবি প্রদর্শনে সমস্যা ও অন্যদিকে মেশিনের ভাড়া দিতে গিয়ে প্রযোজককে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি এসব সমস্যা দূর করতে ভারতের সহায়তায় সার্ভারের মাধ্যমে প্রদর্শন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিলেও নানা জটিলতায় আজও তা আলোর মুখ দেখেনি।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিন জানান, ২০১০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সমিতির কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জেলা শহরে ডিজিটাল সিনেমা হল নির্মাণে সহায়তার জন্য তাকে অনুরোধ জানান। সমিতির অনুরোধে প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক নির্দেশে তৎকালীন ডিএফপির মহাপরিচালক ড. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন এবং চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান সুরথ কুমার সরকারের সমন্বয়ে দুই সদস্যের একটি সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটি গঠন করা হয়। ২০১১ সালের ৬ জুন চলচ্চিত্র প্রদর্শক, প্রযোজক ও শিল্পী সমিতির নেতা, বিভিন্ন সিনেপ্লেক্স মালিক এবং ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নিয়ে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড কার্যালয়ে এ বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি এবং তা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, সরকার চায় জেলা শহরে পুরনো যেসব সিনেমা হল ভালো অবস্থায় রয়েছে সেগুলো সংস্কার করে ডিজিটালে রূপান্তর করা হোক। প্রয়োজনে সরকার ব্যক্তি-মালিকানাধীন হলগুলোকে পাবলিক লিমিটেডে পরিণত করে যৌথভাবে ডিজিটাল হল নির্মাণ করবে। তিনি বলেন, ১৫ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছিল, এ মুহূর্তে নতুন ডিজিটাল সিনেমা হল নির্মাণ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এর পরিবর্তে পুরনো সিনেমা হলকে সংস্কারের মাধ্যমে ডিজিটালে রূপান্তর করা সম্ভব। তিনি বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে আরও জানানো হয়, ডিজিটাল সিনেমা হলের অভাবে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নির্মাতারা ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারছেন না। এদিকে ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট তথ্য মন্ত্রণালয়ে চলচ্চিত্রকারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তথ্যসচিব মরতুজা আহমেদ আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ ও সংস্কারে সরকারের অনুদান দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানান। সচিব আরও জানান, পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতি জেলায় তথ্য অফিসের নিজস্ব ভবন স্থাপন করা হবে। এসব ভবনে একটি করে ডিজিটাল প্রযুক্তির সিনেমা হল থাকবে। পরিকল্পনাটি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।