কথা ছিল বায়ুদূষণ কমানো, কৃষিজমির ওপরিভাগের মাটি রক্ষা ও গাছ কাটা বন্ধ করতে ২০২৪-২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি নির্মাণকাজে পোড়ানো ইটের ব্যবহার শতভাগ বন্ধ করা হবে। পরিবর্তে ব্যবহার করা হবে পরিবেশবান্ধব ব্লক। পর্যায়ক্রমে সরকারি-বেসরকারি সব নির্মাণে ব্লকের ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদের পাশাপাশি ব্লক ফ্যাক্টরি স্থাপনে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধাসহ দেওয়া হবে নানা নীতিগত সহায়তা। ইটভাটাগুলোকে ব্লক ফ্যাক্টরিতে রূপান্তরে দেওয়া হবে নানা সুযোগসুবিধা। অথচ ছয় বছর ধরে পরিকল্পনা শুধু কাগুজে দলিল হিসেবেই রয়ে গেছে। অর্জনের খাতা শূন্য। বর্তমানে ইটভাটা উচ্ছেদ চলমান থাকলেও সেই হারে বাড়ছে না ব্লক উৎপাদন। ইটভাটার মালিকরা ব্লক ইট তৈরির জন্য প্রস্তুত থাকলেও তাদের দেওয়া হচ্ছে না কোনো ধরনের প্রণোদনা বা আর্থিক সুবিধা।
তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি নির্মাণ কাজে শতভাগ ব্লক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ২০১৯ সালে পরিকল্পনা গ্রহণ করে তৎকালীন সরকার। ওই বছর ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন-২০১৯ সংসদে পাস হয়। এরপর সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক ব্যবহারের কর্মপরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রা বাধ্যতামূলক করা হলো। লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়, ২০১৯-২০ সালের মধ্যে সরকারি নির্মাণ কাজের ১০%, ২০২০-২১ সালের মধ্যে ২০%, ২০২১-২২ সালের মধ্যে ৩০%, ২০২২-২৩ সালের মধ্যে ৬০%, ২০২৩-২৪ মধ্যে ৮০% এবং ২০২৪-২৫ সালে ১০০% ব্লক ইট ব্যবহার করতে হবে। তবে ব্লক উৎপাদনকারীরা বলছেন, সরকারি নির্মাণকাজে এখনো ব্লকের ব্যবহার ২০ শতাংশের কম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কংক্রিট ব্লক তৈরিতে বনজ সম্পদ ধ্বংস হয় না। এগুলো পানি, তাপ ও চাপের বিরুদ্ধে বেশি টেকসই, দ্রুত নির্মাণ সম্ভব, নিম্ন কার্বন নিঃসরণ করে, সার্বিকভাবে নির্মাণ খরচ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। সাধারণ ইটের চেয়ে এসিসি ব্লকের ওজন ৪০ ভাগ কম হওয়ায় ভবনের ওজন কম হয়, শব্দ ও তাপ প্রতিরোধী, করাত দিয়ে যে কোনো আকারে কাটার সুযোগ থাকায় ইটের মতো অপচয় হয় না। তবুও সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার অভাবে ব্লক বাজার পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ কংক্রিট ব্লক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্লক ফ্যাক্টরি স্থাপনে যেখানে নীতিগত সহায়তা ও প্রণোদনা দেওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বিভিন্ন ধরনের ব্লক বিক্রিতে চাপানো হয়েছে ভ্যাটের বোঝা। ছিদ্রযুক্ত ব্লকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হলেও ছিদ্র ছাড়া কংক্রিটের ইটে ভ্যাট পোড়ানো ইটের চেয়ে প্রায় ২৩ গুণ বেশি। এতে ইটের চেয়ে ব্লকের দাম বেশি পড়ে। এ কারণে ইটভাটা মালিকরাও ব্লকে যেতে উৎসাহিত হচ্ছে না। এ ছাড়া একটা ব্লক ফ্যাক্টরি স্থাপনে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। সরকারি প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণ ও নীতি সহায়তা ছাড়া এটা সম্ভব না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০২২ সালের ডিসেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ৭ হাজার ৮৮১টি ইটভাটা ছিল, যার ৪ হাজার ৬৩৩টি অবৈধ। গত বছরের শেষ দিকের হিসাবে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮৩৬টিতে। অর্থাৎ উচ্ছেদের পরও অবৈধ ইটভাটা বেড়েছে। যদিও গত ২ জানুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ৬৮৭টি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। তবে বাজারে বিকল্প ইটের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ভাটাগুলোকে ব্লক ফ্যাক্টরিতে রূপান্তরে কোনো পদক্ষেপ আজ অবধি নেওয়া হয়নি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্লক বা বিকল্প ব্যবহার প্রোমোট করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত শুধু ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। আমি ইতোমধ্যে ব্লক ও ইট প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আবার বসব। টার্গেট ঠিক করে আবার এগোব। গৃহায়ন ও গণপূর্ত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক ও জনপথ বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে ব্লক উৎপাদনে যাওয়ার চেষ্টা করব।
ইটভাটা মালিকরা বলছেন, দেশে বৈধ-অবৈধ মিলে প্রায় ১০ হাজার ইটভাটা চলছে। এগুলোতে বছরে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি ইট তৈরি হয়। সেখানে ছয় বছরে ব্লকের ফ্যাক্টরি এখনো তিন শর নিচে। কারণ ব্লক সম্প্রসারণে কার্যকর কোনো কর্মপরিকল্পনাই তৈরি হয়নি। ইটভাটা বন্ধ করে ব্লক ফ্যাক্টরি করতে বিপুল অর্থ প্রয়োজন, যা অধিকাংশ ভাটা মালিকের পক্ষে বহন করা সম্ভব না। স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, প্রণোদনা ও নীতিসহায়তা ছাড়া এটা বাস্তবায়ন সম্ভব না। এ ছাড়া ব্লক দিয়ে নির্মাণকাজ করতে দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পল্লি বা মফস্বল এলাকায় ব্লক দিয়ে নির্মাণকাজ করার মতো রাজমিস্ত্রি পাওয়া যায় না। এটাও ব্লকের ব্যবহার না বাড়ার অন্যতম কারণ। এসব কারণে ইটভাটা মালিকরা ব্লকে যেতে পারছে না।
তথ্যানুযায়ী, একটি মাঝারিমানের ইটভাটায় বছরে গড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টন কাঠ পোড়ানো হয়। এভাবে প্রতিবছর কয়েক লাখ টন কাঠ পোড়ানো হয়। এতে একদিকে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে বায়ুদূষণ। বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০০ একর কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এ জমির ৮০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে অপরিকল্পিত গ্রামীণ আবাসনের জন্য, ১৭ শতাংশ নষ্ট হয় ইটভাটার কারণে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বছরে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় ৪০ মিলিয়ন টন, যার ২২ দশমিক ৫ শতাংশ হয় ইটভাটা থেকে।