টেলিগ্রাফ প্ল্যান্ট, যার বৈজ্ঞানিক নাম কোডারিওকালিক্স মোটরিয়াস প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এই উদ্ভিদটি তার স্বতঃস্ফূর্ত নাচার ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত। পাতাগুলো নিয়মিতভাবে নড়াচড়া করে, দেখে মনে হয় সত্যিই কেউ নাচছে। ভারতীয় উপমহাদেশে এটি ‘নর্তকী গাছ’ নামে পরিচিত এবং গাছটি প্রধানত ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে পাওয়া যায়। এই উদ্ভিদের নাচের পেছনে রয়েছে এক বিশেষ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। পাতার গোড়ায় অবস্থিত পালভিনাস কোষ দ্রুত জলশূন্যতা ও পুনঃজলায়ন করতে পারে, যা টারগর প্রেসার পরিবর্তনের মাধ্যমে নড়াচড়া সৃষ্টি করে। আলোর প্রতি এর সংবেদনশীলতা, যাকে ফোটোট্রপিজম বলে এবং স্পর্শকাতরতা বা সিসমোন্যাস্টিক মুভমেন্ট এ প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করে।
বিখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু এই উদ্ভিদ নিয়ে গভীর গবেষণা করেন। তিনি প্রমাণ করেন, উদ্ভিদেরও এক ধরনের স্নায়ুবিক ব্যবস্থা আছে এবং এটি বৈদ্যুতিক স্পন্দনের মাধ্যমে নড়াচড়া করে। তার আবিষ্কৃত ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রে এই নড়াচড়া রেকর্ড করা সম্ভব হয়েছিল।
আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, টেলিগ্রাফ প্ল্যান্টের পাতাগুলো ৩-৫ মিনিট পরপর নড়ে এবং প্রতিবার ২-৩ ডিগ্রি কোণে অবস্থান পরিবর্তন করে। এটি ২৪ ঘণ্টায় একটি সম্পূর্ণ চক্র শেষ করে, তবে রাতে এর নাচের গতি কমে যায়। এই উদ্ভিদ শুধু বিস্ময়করই নয়, অনেক উপকারীও। এটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ এবং শিক্ষামূলক কাজে ব্যবহৃত হয়। কিছু সম্প্রদায় এটিকে ঔষধি গুণের জন্য ব্যবহার করে।
টেলিগ্রাফ প্ল্যান্ট চাষ করতে উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশ, ভালো নিষ্কাশনযুক্ত মাটি এবং পরোক্ষ সূর্যালোক প্রয়োজন। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে বাংলাদেশে এই প্রজাতি এখন বিরল হয়ে উঠছে। আইইউসিএন এটিকে প্রায়-বিপদগ্রস্ত প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
স্থানীয়ভাবে একে ‘প্রেমিক-প্রেমিকার গাছ’ বলা হয়, কারণ দুটি পাতা একসঙ্গে নাচতে দেখা যায়। আগে মানুষ পাতার নাচ দেখে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতেন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ ধরনের উদ্ভিদ অধ্যয়ন ভবিষ্যতে বায়োনিক রোবটিক্স ও পরিবেশ পর্যবেক্ষণে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়