২০০৬ সালের কোনও এক শনিবার খুব ভোরে রওনা দিলাম রোম থেকে নেপলসের উদ্দেশ্যে। দেখবো সেই মৃত নগরী পম্পেই যা কিনা ৭৯ খ্রিস্টাব্দে আগ্নেয়গিগিরি ভিসুভিয়াসের লেলিহান শিখা আর জলন্ত লাভার নিচে ১৬০০ বছর ঢাকা পড়ে ছিল । বিশাল এসি বাসভর্তি ট্যুরিস্ট বেশীরভাগই আমেরিকান তবে কিছু স্প্যানিশ আর দুজন ছিলে কলম্বিয়ান। কেউ এসেছে পরিবারসহ, কেউবা বন্ধু নিয়ে। এশিয়ানদের মধ্যে আমরা দু'জন, আমি আর আমার স্বামী। গাইড মেয়েটি জানালো তার নাম জিয়ানী, আর ড্রাইভারের নাম রোলান্ডো।
শহর ছাড়িয়ে হাইওয়েতে উঠলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি হাতের বায়ে আপেনাইন পর্বতমালা যা কিনা বুট জুতার আকৃতি ইতালিকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে দু'ভাগ করেছে লম্বালম্বিভাবে। আলপ্স পর্বত থেকে যার উৎপত্তি সে যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে নেপলস পর্যন্ত। দূরে পাহাড়ের উপর কোনো এক বিখ্যাত সন্ন্যাসীর মঠ যা আমাদের ভ্রমণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্ত গাইড বাসের জানালা দিয়েই আমাদের মঠ দর্শন পর্ব শেষ করলো।
নেপলসে নেমে সেখানকার বিখ্যাত মিউজিয়াম আর চার্চ দেখলাম ঘুরে ঘুরে। নেপলস শহরটি একদম সমুদ্রের তীরে। সুনীল টাইরেনিয়ান সি। নেপলস বন্দর। বিশাল বিশাল জাহাজ ভীড়ে আছে। যারা ক্যাপ্রি দ্বীপে যাবে তারা নেমে গেল। ক্যাপ্রির সেই বিশাল ওশেন লাইনার দেখে আমার ভীষণ আফসোস হচ্ছিল। কারণ অনেকবারই ট্যুরিস্ট কোম্পানি আমাদের ক্যাপ্রির রূপ সৌন্দর্যের বিবরণ দিয়ে সেখানে যাবো কিনা জানতে চেয়েছিল, কিন্ত পানির প্রতি ভয় আমাকে রাজি করাতে পারেনি।
যাক এখন আর আফসোস করে লাভ নেই। আমরা সেখানে নেমে একটু ঘুরলাম কি ভালো লাগছিল তবে প্রচণ্ড রোদ ছিল।এর মধ্যেই কয়েকজনকে দেখলাম আগুনের মতো তপ্ত সেই পাথরের উপরে শুয়ে রৌদ্রস্নান করছে!
নেপলস ছেড়ে হাতের ডানদিকে গর্জনশীল ভিসুভিয়াস পর্বত আর গভীর নীল টাইরেনিয়ান সমুদ্রের পাশ ঘেষে আমরা যাচ্ছি পম্পেই।তখন দুপুর বারোটা বাজে। আমাদের বাস পম্পেই নগরীর ধ্বংস্বাবশেষের পাশে এসে থামলো। সেখানে বিরাট এক প্রবাল আর ক্যামিওর কারখানা। ভূমধ্য সাগরের প্রবাল পৃথিবী বিখ্যাত। ক্যামিও হচ্ছে ঝিনুকের খোলটা যা ঘঁষে সাদা করে গহনায় ব্যবহার করা হয়। এটা আমাদের দেশেও আগে গহনা বিশেষ করে লকেটে ব্যবহার করা হতো। সেখানে কে কি কিনলো জানি না তবে আমরা কিছু কিনি নাই।
প্রচণ্ড গরম সূর্যের গনগনে তাপে সবকিছু যেন পুড়ে যাচ্ছে। কারখানার সামনেই ত্রিপল টাংগানো ওপেন রেস্টুরেন্ট। দুপুরের খাবার সেখানেই খেতে বসলাম সবাই। আমাদের টেবলে আমরা ছাড়া দুই কলম্বিয়ান ভদ্রমহিলা আর আট দশ বছরের বাচ্চাসহ এক আমেরিকান ভদ্রলোক। যথরীতি সেই বিস্বাদ পিৎজা আর পাস্তা। আমি আর বাচ্চা ছেলেটা শুধূ লুকিয়ে পাউরুটি খাচ্ছিলাম। ওর বাবা জানালো গত ৫ দিন ধরে সে পাউরুটিই খাচ্ছে। মনে পড়লো বাংলাদেশের পিৎজার কথা, যার টেস্টই আলাদা।
অদূরেই ভিসুভিয়াস পর্বত,মেঘের গর্জনের মতন গুম গুম শব্দ করেই চলেছে আর তার শব্দে চারিদিক কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি জানি তখনই কিছু হবে না। পাহাড়ের ঢালে অনেক ঘর বাড়ি, তবুও ভয় ভয় লাগছিল। সে সময় ইউরোপে রোমান সম্রাটদের শাসনামলে উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল এই পম্পেই ও তার সহোদরা নগরী হার্কুলেনিয়াম। ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্পকলা বিশেষ করে আধুনিক নগরায়ণের এক চূড়ান্ত উৎকর্ষের প্রতীক ছিল পম্পেই। কিন্ত ৭৯ খৃস্টাব্দে নগর থেকে অল্প কিছু দূরত্বে থাকা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াসের দুদিনের ভয়ংকর অগ্নুৎপাতে চার থেকে ছয় ফুট জলন্ত লাভার নিচে মুহূর্তের মধ্যে চাপা পড়ে গেল সে দুটি নগরী যেখান থেকে খুব কম সংখ্যক লোকই বাঁচতে পেরেছিল।
১৬০০ বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার পর ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে আকস্মিকভাবে এই দুটি নগরী আবিস্কৃত হয় যা সমগ্র বিশ্বে এক তুমুল আলোড়ন তোলে। পরবর্তীতে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে এই নগরীকে। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে পম্পেই।
এখানে আমাদের গাইড পরিবর্তন হয়ে আসলো একজন বয়স্ক রসিক ভদ্রলোক, টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম সেই মৃত পুরীতে। গাইডের মুখ থেকেই শুনলাম উপরের এইসব জানা-অজানা ইতিহাস। সে আমাদের সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে শুরু করলো। প্রথমেই দেখলাম নগরীর প্রধান দেবতা সুর্য দেব এ্যাপলোর মন্দির, পম্পেই শহরে ঢোকার মুখেই প্রধান দেবতা জিয়াসের মন্দির। এরপর গ্ল্যডিয়েটরস বা ক্রীতদাসদের থাকার জন্য ব্যারাক। পরিকল্পিত এই নগরীতে ছিল প্রধান দুটো সড়ক। রাস্তাকে ল্যাটিন ভাষায় বলে ভিয়া, একটার নাম ভিয়া স্ট্যবিয়ানা আরেকটার নাম ভিয়া আব্বনডানজা। প্রতিটি রাস্তাই আগ্নেয় পাথরে বাধানো এবং রাস্তার দুপাশেই ফুটপাথ। আর একটু পর পর চার কোনা পাকা করা হাউসের মধ্যে পাইপের সাহায্যে পানীয়জল সরবরাহের ব্যবস্থা। গাইড দেখালো পাথরের বেদীতে ঝুঁকে পানি খেতে খেতে পাথরটি কিভাবে একদিকে ক্ষয় হয়ে গেছে। সেই কত শত হাজার বছর আগেই পাইপের মাধ্যামে শহরের রাস্তায় পথিকদের জন্য পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা।
রাস্তার দু'পাশেই ধনী এবং সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়ী। আরো ছিল পাথরের বাথটাব বসানো পাবলিক বাথ, যেখানে সমাজের উঁচু স্তরের লোকজন গোসলের ফাঁকে ফাঁকে রাজনৈতিক ও সামাজিক খোশগল্প এবং বিনোদনে ব্যস্ত সময় কাটাতো। একটা ঘরের মধ্যে দেখলাম বেশ কিছু লোকের মৃতদেহ পাথর হয়ে আছে, সঙ্গে ছোট বাচ্চা আর কুকুরও আছে।
এই যে জীবন্ত মানুষগুলো ফুটন্ত লাভার করাল গ্রাসে মুহূর্তের মধ্যে ফসিলে পরিণত হয়েছিল, ঐতিহাসিকরা মনে করেন তারা পরবাসী, কোনো কারণে পম্পেই এসে রাতের মত সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্ত সে আশ্রয় ছিল তাদের শেষ আশ্রয়স্থল। কী ভয়াবহ এক শোচনীয় মৃত্যু!
মৃত পম্পেই নগরীতে আমরা জীবিত মানুষরা হেঁটে হেঁটে দুপাশে কবরে পরিণত হওয়া বাড়িগুলো দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। গ্রিল দিয়ে বন্ধ একটা বাড়ি দেখিয়ে গাইড বললো, এটা এক ট্র্যাজিক কবির বাড়ী। বাইরে থেকেই গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখলাম ঘরে ঢোকার প্রধান দরজার মেঝেতে মোজাইক করা কুকুরের একটি ছবি তার নিচে ল্যাটিন ভাষায় লেখা 'ক্যাভে ক্যানেম' অর্থাৎ 'বিওয়্যার ওফ দ্য ডগ'। গাইড জানালো এটাই নাকি পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কুকুর থেকে সাবধান হবার লিখিত বাণী।
এরপর দেখলাম রাস্তার পাশেই পম্পেইর নামকরা অত্যন্ত ধনী ব্যাক্তির এক বিশাল বাগানবেষ্টিত বাড়ি, বাড়ির নাম 'হাউস অব দ্য ড্যান্সিং ফন'। গেইট দিয়ে ঢুকতেই বাধানো এক চত্বর তার মাঝখানে একটু নীচু চৌবাচ্চা। সেটার মধ্যে বন আর পশু-পাখির দেবতা ফনের নৃত্যরত একটি ছোট্ট ব্রোঞ্জের মূর্তি। যা হাজার হাজার বছর ধরে জলন্ত লাভা এবং পরবর্তীতে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া সেই কঠিন শক্ত ঝামা পাথরের নিচে থেকেও অবিকৃত আছে। প্রাঙ্গণের চারিদকে চেরি, পাইন, দেবদারু আর পামগাছ। গাইড জানালো বাড়ির মালিক অগ্নুৎপাতের সময় তার সোনার মোহরের বস্তা নিয়ে পালনোর ব্যর্থ চেষ্টা করে মারা গিয়েছিল, তার বাড়ির উঠোনেই জলন্ত লাভার নিচে চাপা পড়ে। সে বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে লাল রঙে আঁকা কত ছবি তবে তার বেশিরভাগই অস্পষ্ট।
প্রধান সড়ক ধরে আমরা হেঁটে যাচ্ছি এলোমেলোভাবে। তপ্ত রোদে গা পুড়ে যাচ্ছে। এমন সময় গাইডের নির্দেশে তাকিয়ে দেখি একটি বেকারি, দেখলাম তার মধ্যে গম ভাঙ্গানো থেকে রুটি বানানোর চুলাসহ বিভিন্ন উপকরণ। কিছু গম জাতীয় শস্যও দেখালো গাইড। মনে করা হয় অগ্নুৎপাতের ঠিক আগ মুহূর্তেও সেখানে কাজ চলছিল।
সবশেষে গাইড আমাদের নিয়ে গেল পম্পেই নগরীর বিখ্যাত (চারিত্রিক কারণে কুখ্যাত) ভেট্টি ভাইদের বাড়িতে। বাড়িটিতে ঢোকার আগেই গাইড এই দুই ভাইয়ের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে আমাদের অবহিত করলো। গাইডের ভাষায় দশ বছর আগেও দেখার জন্য কোন নারীর সেই ভাইদের বাসায় প্রবেশাধিকার ছিল না। এখন আধুনিক জামানা তাই সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে বলে গর্ব ভরে নারীদের দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি উপহার দিল!
ভেতরে ঢোকার আগেই অপ্রস্ততই হলাম। চৌকোনা সেই বাড়ির বিভিন্ন দেয়ালের গায়ে আঁকা আছে যথারীতি নারী-পুরুষের ভোগ লালসার বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি যা কোনো শিল্পের মর্যাদায়ই পড়ে না। অর্থ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই তাদের নাম পম্পেই নগরবাসীর কাছে সুবিদিত ছিল। মাঝখানে বাগানের দিকে মুখ করে চারিদিকে ঘোরানো বারান্দাওয়ালা চারকোনা একতালা বাড়িটি টালির ছাদ দেয়া। বাড়িটি ছিল নগরীতে প্রবেশের দুটি পথের একটি ভিসুভিয়াস গেটের একদম পাশে, যেখান থেকে খুব কাছে জীবন্ত ভিসুভিয়াস পর্ব্তটাকে সোজা দেখা যাচ্ছিল, অগ্নৎপাতের সময় লাভা এসে আমার মনে হয় ওদেরই প্রথম ঢেকে দিয়েছিল। অনেকেই বলে এটা ছিল পম্পেই নগরবাসীর তথা ভেট্টি ভাইদের পাপের শাস্তি! তাদের এতো পাপ বোধহয় ধরিত্রীও সহ্য করতে পারেনি। তাই যদি হয় তবে সেখানে কি কোনো ভাল মানুষই ছিল না!