মরে যাচ্ছে পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে প্রবাহিত ৩৩টি নদী। উৎসমুখে ভারত বাঁধ ও স্লুইস গেইট নির্মাণ করায় এসব নদ-নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। এক সময়ে দুকূল প্লাবিত করে প্রবাহিত এসব নদীর বুকে জেগে উঠেছে বালুচর। পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ না থাকায় নদীর বুকে স্থানীয় কৃষকেরা বোরোর আবাদ করেছেন।
ফলে বিরূপ প্রভাব পড়েছে কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ওপর। মাছ প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। পাখির বিচরণ ক্ষেত্রে কমে আসছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত এক জরীপে জানা গেছে, ভারত থেকে আসা পঞ্চগড় জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া, মহানন্দা, চাওয়াই, করুম, তালমা, পাম, ডাহুক, গোবরা, , বেরং, ছোট যমুনা, ছেতনাই, পেটকি, ঘোড়ামাড়া, মরাতিস্তা, সুইঁ নদী এখন বির্স্তীণ বালিয়াড়িতে পরিণত হয়েছে। এসব নদীর বুকে কৃষকরা বোরো আবাদ করেছেন। মূলত উজানে এসব নদীতে ভারতীয় অংশে বাঁধ বা স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে নদীগুলো জীর্ণ হয়ে পড়েছে।
এদিকে, পঞ্চগড়ে উৎপন্ন নদীগুলোর অবস্থাও একই রকম। তীরনই, রণচণ্ডি, টাঙ্গন, পাথরাজ, ভেরসা, আত্রাই, পাংগা, পাথরাজ, নাগর নদীর উৎসমুখ জেলার বিভিন্ন খাল বিল অথবা নদীর মোহনা। এসব নদীতে বংলাদেশ কর্তৃক স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে প্রায় মরে গেছে। এ ছাড়াও মানুষ কর্তৃক নদী শাসনের ফলে নদীগুলোর স্রোতধরা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এরমধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলার ভূতিপুকুর গ্রামে ভেরসা নদীর উৎসমুখ শুকিয়ে গেছে। ফলে ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর হারিয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ডিমগজ গ্রামের কৃষক রফিজউদ্দিন (৮৫) জানান, ‘আগে ভেরসা নদীতে অনেক পানি ছিল। মাছ ছিল প্রচুর। ১ ঘণ্টা মাছ মারলে ৫ কেজি মাছ নিয়ে বড়ি ফেরা যেতো। সেই নদী আর নাই, মাছও নাই। সমতল ভূমি কেটে অথবা বেমা মেশিন দিয়ে পাথর তুলে বালি বিভিন্ন নদীতে ফেলার কারণেও অনেক নদীর প্রবাহ বন্ধ হযে যাচ্ছে। জমিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার এবং নদীর পানিতে মযলা আর্বজনা ফেলাসহ নদী ভরাট করে বসতি স্থাপন করায় নদীর স্বাভাবিক গতি পরিধি কমে গেছে। নদী হারিয়ে ফেলেছে তার স্বাভাবিক অবস্থা। ফলে নদী পরিণত হয়েছে মরা নদীতে। বালুচর জেগে উঠছে।
পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ভারত জেলার তেঁতুলিয়া সীমান্তের বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের পশ্চিম-উত্তর কোণে মহানন্দা নদীর ওপর বিশাল বাঁধ নির্মাণ করেছে। “ফুলবাড়ি ব্যারাজ” নামে খ্যাত এ ব্যারাজ নির্মাণের পর থেকে জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৬ সালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ “তিস্তাা-মহানন্দা” নামের বাঁধটি নির্মাণ করে। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে ফিডার ক্যানেলের সাহায্যে এই নদী থেকে পানি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের মরুকবলিত এলাকায় তারা সেচ কাজ করছে । বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে জেলার সবকটি নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করায় নদীগুলোর নাব্যতাও আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানিও অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বর্ষাকালে বাঁধ খুলে দিলে বন্যাসহ দুকূল ভেঙ্গে যায়। ফলে নদীপাড়ের মানুষেরা নানা সমস্যায় পড়ে। নদী মরে যাওয়ার কারণে মাছ, জলজ পাখি, জলজ অন্যান্য প্রাণী যেমন: শামুক, কাছিম, ঝিনুক বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নানান জলজ উদ্ভিদ এবং জীব বৈচিত্রের অন্যবদ্য অংশ জলজ অন্যান্য কীটপতঙ্গ নদীর দুই ধারে ছোটছোট ঝোপঝাড় ইত্যাদি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অনেকাংশে ধ্বংস হয়ে গেছে। জলজ পাখির মধ্যে ডাহুক, জলমুরগি, বালিহাঁস, বিভিন্ন প্রকার সারস, সাপ বিচরণ ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দুই পাড়ে ঝোপঝাড়ে বিভিন্ন পাখি ডিম পাড়ে। এরা আর ডিম পাড়তে পারে না।
পঞ্চগড় পরিবেশ পরিষদের সভাপতি তৌহিদুল ইসলাম বারি বলে, ‘নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় জেলার প্রকৃতিক পরিবেশ বৈচিত্র হুমকির মুখে। খুবই খুব শিঘ্রই নদীগুলো ড্রেজিং-এর উদ্যোগ নেয়া উচিত। উৎস মুখে বাঁধ নির্মাণের ফলে পঞ্চগড়ের নদনদীগুলো শুকিয়ে গেছে। জীববৈচিত্রের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। মাছের ও পাখির বিচরণ ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। মাছ বংশ বিস্তার করতে পারছে না। নদীর বুকে বোরো আবাদ করা হচ্ছে। এসব ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব কীটনাশকের প্রভাবে মাছের প্রজনন কমে যাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ নির্বাহী প্রকৌশলী ভানু জয় দাস বলেন, নদ-নদীগুলোর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করার ফলে পঞ্চগড় জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। বিষয়গুলো উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করে সমাধান করা যেতে পারে। এসব নদ-নদী ড্রেজিং করে বাঁধ এবং স্লুইস গেট নির্মাণ করে পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে কৃষি ক্ষেত্রে সেচ সুবিধা ব্যবহার করা সম্ভব। এর ফলে ধান, গমসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ বৃদ্ধি পাবে এবং এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ লাভবান হবে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।
বিডি-প্রতিদিন/ ১৮ মে, ২০১৫/ রশিদা