২ এপ্রিল, ২০২৩ ১১:১৩

নারান্দিয়া গ্রামের হাতে ভাজা মুড়ির কদর দেশজুড়ে

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

নারান্দিয়া গ্রামের হাতে ভাজা মুড়ির কদর দেশজুড়ে

রমজান মাসের ইফতারি তৈরিতে রকমারি উপাদানের মধ্যে মুড়ি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। মুড়ির চাহিদা সারা বছরব্যাপী থাকলেও রোজার সময় এর উৎপাদন এবং বিক্রি অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাই মুড়ি ব্যবসায়ীরা বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকেন এ মাসটির জন্য। আবার অনেকে মৌসুমি ব্যবসা হিসেবে এই মাসে মুড়ি উৎপাদন এবং বিক্রি করে থাকেন। 

হাতে ভাজা মুড়ির কদর রয়েছে দেশজুড়ে। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া গ্রামসহ ৫টি গ্রামের অনেকেই মুড়ি ভাজার সাথে জড়িত থাকায় মানুষ এই গ্রামগুলোকে মুড়ি গ্রাম হিসেবেও চেনেন।

কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া গ্রামের মুড়ি শুধু টাঙ্গাইল নয়, টাঙ্গাইল ছাড়াও পাড়ি জমায় দেশের বিভিন্ন জেলায় জেলায়। ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, গাজীপুর, ঢাকাসহ বিভন্ন জেলায় চলে যায় নারান্দিয়ার হাতে ভাজা মুড়ি। এখানকার উৎপাদিত মুড়ির সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। মুড়ি উৎপাদনের সাথে এ এলাকার মানুষ অনেক পূর্বে থেকেই জড়িত। মুড়ি উৎপাদনকারি এলাকাগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের নারান্দিয়া গ্রাম শীর্ষে। এছাড়া জেলার কালিহাতি উপজেলার মাইস্তা, নগরবাড়ি, দৌলতপুর, লুহুরিয়া গ্রামে এবং সখীপুর উপজেলার কৈয়ামধু, বেড়বাড়ী, রতনপুর ও কালীদাস গ্রাম গুলোতে প্রায় প্রতিটা পরিবার হাতে ভাজা মুড়ির সাথে যুক্ত। যার কারণে এ গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে ঢুকলেই মনে হয় যেন মুড়ির উৎসব চলছে।

এসব মুড়িতে নেই কোন প্রকারের কোন রাসায়নিক পদার্থ। চাল, লবণ, পানি ও বালু এই চারটি উপকরণের সংমিশ্রণেই এই মুড়ি তৈরি হচ্ছে। কোন মেশিন বা কোন যন্ত্রচালিত কিছু না সবই হাতের করা কাজেই মুড়ি তৈরি হয়। খোলা, বালু খোলা, ঝাইনঝোর, চালুন ও পাটকাঠি এই হলো মুড়ি তৈরির প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র। কেউ রাতে আবার কেউ বেছে নেয় দিন, শুরু হয় তাদের মুড়ি ভাজার কাজ। কেউবা ভাজে বালু কেউবা ভাজে চাল, কেউ আবার বালু থেকে মুড়ি আলাদা করতে ব্যস্ত কিংবা কেউ মেপে মেপে বস্তায় তুলতে ব্যস্ত। এসব কাজই ঘুড়ে ফিরে করতে থাকে তারা। অনেক বাড়িতে একাই অনেক কিছু করতে হয় কিংবা অনেক বাড়িতে শাশুড়ি ছেলের বৌ মিলেই সব সামলে নেয়। ঐসব গ্রামে প্রায় ৩০০ মণ মুড়ি তৈরি হয়। ৫০ কেজি চাল থেকে প্রায় ৪৪-৪৫ কেজি মুড়ি হয়।

নারান্দিয়া গ্রামের আজাহার আলী বলেন, বাড়ির মহিলারাই এই সব কাজ বেশিরভাগ করে থাকে। পুরুষরা হাটে নিয়ে যায় বা আড়তে। এছাড়া অনেক সময় ব্যবসায়ীরাই চলে আসে পিকআপ নিয়ে বাড়িতে। গ্রাম গুলোতে অনেকেই বাপ দাদার এ পেশা বাদ দিলেও এখনো বেশিরভাগ পরিবারের আয়ের একমাত্র উপায় এই মুড়ি ভাজা ও বিক্রি করা।

নারান্দিয়া গ্রামে কানাই মদক বলেন, আমাদের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে মেশিনের মুড়ির জন্য। হাতে ভাজা মুড়িতে অনেক বেশি পরিশ্রম, মেশিনে তা নেই। কম সময়ে বেশি মুড়ি পাওয়া যায় এবং বিক্রি ও করা যায় কম দামে। হাতে ভাজা মুড়ির স্বাদ আর মেশিনে ভাজা মুড়ির স্বাদ হাজারো গুণ পার্থক্য আছে। এখনো যারা হাতে ভাজা মুড়ি খেয়ে অভ্যস্ত তারা মেশিনের মুড়ি খাওয়ার কথা ভাবেই না। দাম বাড়িয়ে নিতে হলে ও হাতে ভাজা মুড়ির প্রাধান্যই আগে সবার কাছে।

মুড়ি ভাজার প্রক্রিয়া একদম যুগে যুগে যেমন চলে আসছে তেমনই। হাতে ভাজা মুড়িতে দেয়া হয়নি এখনো কোন প্রকারের কোন প্রযুক্তির ছোঁয়া মাটির এক চুলায় বসানো হয় চালের জন্য একটি খোলা, অন্য চুলায় বালি সহ আরেকটি খোলা। একটিতে চাল ভাজা হতে থাকে মাঝে ছিটিয়ে দেয়া হয় লবণ পানি এবং ভাজা হয়ে গেলে তা ভাজা বালুর সাথে মিক্সড করলেই ৩০ সেকেন্ড এর মাঝেই ফুট ফুট শব্দে ফুটে উঠতে থাকে মুড়ি। যার স্বাদ এবং গন্ধ অতুলনীয়। এরপরেই চালনীতে চলে মুড়ি আর বালু আলাদা করার কাজ। এভাবেই পালাক্রমে চলতে থাকে কাজ, কেউবা এ কাজ সারাদিন করে, কেউবা সারারাত করে নিজেদের সুবিধামত। এভাবে একদিনে দুইজন মিলে প্রায় দুই মণ চালের ও মুড়ি ভাজা যায়।

আন্না বেগম বলেন, যাদের জমি আছে তারা মুড়ির ধান নিজেরাই উৎপাদন করে। পাটজাক ধান মুড়ির জন্য বিশেষ ভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ও আমিন, বিনা ৭, হরিধান, ২৯ ধান, ১৬ ধান, ৫২ ধান এমন অনেক ধান থেকেই ভালো মুড়ি হয়। আসলে ভালো মুড়ি ডিপেন্ড করে এর ধানের সিদ্ধ পার্ফেক্ট হয়েছে কি না তার উপর। সেই ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে নিজেদের চালেই মুড়ি তৈরি করে। 

মনোয়ারা বেগম বলেন, আসলে হাতে ভাজা মুড়ির পরিশ্রম অনেক বেশি। সেই তুলনায় লবণ, চাল, খড়ির দাম বাড়লেও বাড়েনি মুড়ির দাম। পায় না কোন সরকারি সহযোগিতা ও যার কারণে দিনের পর দিন যেন নিজেদের টিকিয়ে রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।

কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগরে সভাপতি মাজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু বলেন, মুড়িগ্রামের অনেকেই যুগ যুগ নিজেদের বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা পেশাকে বিদায় জানাতে চাইছে এবং অনেকেও পাড়ি জমিয়েছে অন্য পেশায়। তাদের টিকিয়ে রাখতে হলে সহজশর্তে ঋণের ব্যবস্তা করতে হবে।

কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান আনছার আলী বিকম বলেন, নারান্দিয়াগ্রামসহ কয়েকটি গ্রামের মানুষ যুগ যুগ ধরে হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করে জীবনযাপন করে আসছে। এখন জিনিস পত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তাদের অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। তাই তাদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর