বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার

\\\'একাত্তরের ২৯ মার্চ পাকিস্তানে যান সাকা চৌধুরী\\\'

\\\'একাত্তরের ২৯ মার্চ পাকিস্তানে যান সাকা চৌধুরী\\\'

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর পক্ষে জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি পক্ষের তৃতীয় সাক্ষী কাউউম রেজা চৌধুরী। গতকাল বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই জবানবন্দি গ্রহণ করেন। জবানবন্দিতে কাইউম রেজা চৌধুরী জানান, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সাকা চৌধুরী পাকিস্তানে চলে যান। ১০ এপ্রিল সালমান এফ রহমানের করাচির বাসায় যান সাকা চৌধুরী। সাক্ষী দাবি করেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় রেসকোর্স ময়দানে সাকা চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। জবানবন্দি শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ। জেরার কার্যক্রম আজ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ৬৩ বছর বয়সী কাইউম রেজা চৌধুরী জবানবন্দিতে বলেন, ফজলুর রহমান ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে আমার বাবা মোর্তজা রেজা চৌধুরী তার দুই শালির বিয়ে দেন। বাবা ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরে আমার বাবাকে ইস্কান্দার মির্জা কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার নিয়োগ করেন। আমি তখন কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করতাম। বড় ভাই মইনুর রেজা চৌধুরী সেন্ট জেভিয়ার পাটনাতে পড়াশোনা করতেন এবং পরে তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হন। কাইউম রেজা চৌধুরী বলেন, ১৯৫৬ সালে কলকাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আতাউর রহমান খান আমাদের কলকাতার বাসায় আসেন। ওই সময় আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জীবনে প্রথম আমার দেখা হয়। ১৯৬৪ সালে শাহিন স্কুলে ভর্তি হই। এই স্কুলে শেখ কামাল এবং নিজাম আহমেদের (এই মামলায় দ্বিতীয় সাফাই সাক্ষী) সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমি এবং শেখ কামাল খেলাধুলায় পারদর্শী থাকার কারণে আমাদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ ছিল, যদিও শেখ কামাল আমার চেয়ে এক ক্লাস নিচে পড়ত। এই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে আমি ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তি হই। সেখানে সালমান এফ রহমান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং নিজাম আহমেদও ভর্তি হন। সাক্ষী জানান, নটর ডেম কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় সেখানে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ইনডোর-আউটডোর গেমসের মতো অন্যান্য বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হতো এবং সাকা চৌধুরী ইন্টার কলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নটর ডেমের প্রতিনিধিত্ব করতেন। নটর ডেম কলেজে ভর্তি হওয়ার সুবাদে কাজিন সালমান এফ রহমান, সাকা চৌধুরী এবং বন্ধু নিজাম আহমেদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সাক্ষী বলেন, আমরা প্রায়ই ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে যেতাম। নিজাম আহমেদের বাড়ি এবং বঙ্গবন্ধু বাড়ির মাঝে যাতায়াতের জন্য একটি ছোট গেট ছিল। গেটটি এখনো আছে। সাক্ষী জানান, নটর ডেম কলেজ থেকে পাস করে পরে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কাইউম রেজা চৌধুরী বলেন, আমরা যখন ভর্তি হই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলনের জন্য উত্তপ্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করা হলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ আমরা তার মুক্তির আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। সাক্ষী বলেন, আমার বাবা মারা যাওয়ার পর বিহারের সম্পত্তি হারানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে নবাব শাহ সিন্ধে ৯ হাজার বিঘা তুলা উৎপাদনের জমি আমাদের দেন। পাকিস্তানে এত সম্পত্তি পাওয়ার পরেও আমাদের মধ্যে এই চেতনা ছিল যে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের কারণ যৌক্তিক। খন্দকার আমিনুল হক বাদশার (বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব) সুবাদে এবং অনুপ্রেরণায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পায়। এই আন্দোলনের সময় আমরা যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলাম, তারা 'জয় বাংলা' স্লোগান দিতাম। আন্দোলনকারীদের একটা অংশের স্লোগান ছিল 'দুনিয়ার মজদুর এক হও'। আসামি পক্ষের এই তৃতীয় সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ইংল্যান্ড এবং পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রিকেট খেলা চলাকালীন অ্যাসেম্বলির অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় খেলা পণ্ড হয়ে যায়। আমার ইংরজিতে ভালো দখল থাকার কারণে ওই সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে বিদেশি সাংবাদিকদের দেখাশোনা ও অনুবাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ওই বছরের ১৭ মার্চ জন্মদিনের অভিনন্দনের জবাবে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, 'কীসের আমার জন্মদিন, কীসের মৃত্যু দিবস; পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্যই আমার জীবন'। সাক্ষী জানান, তিনি এবং বাদশা ২৩ বা ২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিদেশি সাংবাদিকদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারেননি। ২৫ মার্চ রাতে বাদশা, নিজাম আহমেদ, নেওয়াজ আহমদকে নিয়ে তিনি গাড়ি চালিয়ে তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে প্রেস রিলিজ দিতে যান। কাইউম রেজা চৌধুরী বলেন, ওইদিন রাত ১০টার কিছু পর একজন পাকিস্তানি সেনা বন্দুক তাক করে আমাদের হোটেলের মধ্যে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাগজপত্রসহ বাদশা ভাইয়ের ব্রিফকেসটি তখন গাড়িতে আটকা পড়ে। বিদেশি সাংবাদিক সায়মন ড্রিং বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকেও বাধা দেওয়া হয়। আমরা ওই হোটেলে অবরুদ্ধ থাকার সময়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও হারুন আহমেদ চৌধুরীকেও সেখানে দেখি। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে আমি রাজশাহী হাউসে, নিজাম আহমেদ এবং তার ভাই তাদের বাসায় এবং বাদশা ভাই পালিয়ে আত্দগোপনে চলে যান। কাইউম রেজা চৌধুরী বলেন, '৭১ সালের ৮ এপ্রিল সালমান এফ রহমান, নিজাম আহমেদ এবং আমি একই বিমানে করাচি গিয়ে সালমান এফ রহমানের বাসায় উঠি। দুই দিন পরে ওই বাসায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যান। তবে বাসায় না থাকার কারণে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। জেরায় সাক্ষী বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা কখনো বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে সমর্থন করেছিলেন কি না তা আমার জানা নেই।

মুনীর চৌধুরীর ছেলের সাক্ষ্য গ্রহণ : মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত একাত্তরের আলবদর নেতা চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিয়েছেন প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী আসিফ মুনীর চৌধুরী তন্ময়। গতকাল বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ জবানবন্দি গ্রহণ করেন। পরে এ মামলার কার্যক্রম আগামীকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। জবানবন্দিতে আসিফ মুনীর চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমার বাবা অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের বাসা থেকে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সাক্ষী বলেন, আমার বাবা পঞ্চাশের দশকে বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরে রাজনীতি থেকে সরে আসেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী নীতি এবং কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তার লেখায়। পরে '৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে কাজ করার জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছে। এর আগে এ মামলার প্রথম সাক্ষী শহীদ বুদ্ধিজীবী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদের ভাগি্ন মাসুদা বানু রত্নাকে জেরা করে আসামি পক্ষ। জেরা করেন রাষ্ট্র নিয়োজিত আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনি। গত সোমবার মাসুদা বানু রত্না ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেন।

চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ইংল্যান্ডে আর আশরাফুজ্জামান খান আমেরিকায় বসবাস করছেন। তারা বর্তমানে প্রবাসে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে জানা গেছে। তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার চলছে।

 

 

সর্বশেষ খবর