রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সোনা পাচারে ১৬ সিন্ডিকেট

সাঈদুর রহমান রিমন

 সোনা পাচারে ১৬ সিন্ডিকেট

আন্তর্জাতিক সাত সিন্ডিকেটের সহযোগী হিসেবে দেশি ১৬টি চক্র পরিচালনা করছে সোনা চোরাচালান। এসব চক্রে সরাসরি সম্পৃক্ত বিভিন্ন স্তরের দুই শতাধিক সদস্য। তারা দেশের দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ কয়েকটি পয়েন্টে গড়ে তুলেছে শক্তিশালী ঘাঁটি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ছাড়াও অন্তত আটটি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন যোগসাজশ রয়েছে তাদের। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১২ জন পদস্থ কর্মকর্তাসহ অর্ধ শতাধিক কর্মী সোনা চোরাচালানে সরাসরি ভূমিকা রাখে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অভিযোগ আছে, সিভিল এভিয়েশনের বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যও এ সিন্ডিকেটের সক্রিয় কর্মী। বিমানবন্দরে সোনার চালান আনা-নেওয়া নির্বিঘ্ন করতে রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। দেশের বিমান বন্দরকেন্দ্রিক দলীয় কোনো নেতার তত্ত্বাবধানে রীতিমতো পেশাদার অপরাধী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। বিমানবন্দর ও সংলগ্ন এলাকায় সোনা চোরাচালানিদের আশ্রয়দাতা এসব অস্ত্রবাজ রাত-দিন বিচরণ করে এবং ঘুরে বেড়ায় যথেচ্ছা।  গত কয়েক বছরে দেশে সোনা চোরাচালানিরা অসম্ভব রকমের প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। বিমানবন্দরে বিশেষ নজরদারির মাধ্যমে মণে মণে সোনা আটক করেও চোরাচালানিদের দৌরাত্ম্য কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। বরং মাঝে মধ্যে সোনার চালান আটক হওয়া নিয়ে অবাক হওয়ার মতো নানা তথ্য পাওয়া গেছে। দেশীয় একটি সিন্ডিকেটের অন্যতম সোনা পাচারকারী হিসেবে দীর্ঘদিন সম্পৃক্ত থাকা এক সদস্য জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক সোনার চালান আটক হওয়ার বিষয়টি হাস্যকর। তার ভাষায়, চোরাচালানিরাই তাদের ‘নির্বিঘ্ন পাচারের’ কৌশল হিসেবে ছোট আকারের চালানগুলো ধরিয়ে দেয়। এসব নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার হৈচৈ, ব্যস্ততার ফাঁকেই বড় চালানগুলো অনায়াসে বিমানবন্দর পার করে নেওয়া হয়। স্বেচ্ছায় নিজেদের পাচার করা সোনা ধরিয়ে দেওয়াকে চোরাচালানিদের ভাষায় ‘সিস্টেম’ বা ‘গুচিকাটা’ বলে চিহ্নিত। প্রতিটি বড় চালানের বিপরীতে শতকরা ২০ ভাগ সোনা সিস্টেমে ‘লস’ হিসেবে ধরে নেয় চোরাচালান সিন্ডিকেট। ওই ২০ ভাগের মধ্যেই সোনা জব্দ করিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন সংস্থার সহযোগী কর্মকর্তাদের মাসোহারার টাকারও হিসাব থাকে। চট্টগ্রামের অধিবাসী সংশ্লিষ্ট সোনা পাচারকারী আরও জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বিশেষ কোনো অভিযানে সোনার বড় কোনো চালান যে মোটেও ধরা পড়ে না, তা নয়। সিন্ডিকেটের সামান্য অসাবধানতায় বা কোনো সদস্যের বেইমানির কারণে কখনো কখনো সোনার মূল চালানও আটকা পড়ে যায়। জানা যায়, ভারতে সোনা আমদানি বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক চোরাকারবারীরা বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতে সোনা পাচারের রুট বেছে নেয়। দুবাইসহ আরব দেশগুলো থেকে শত শত কেজি সোনা সংগ্রহের মাধ্যমে তা সরাসরি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সিন্ডিকেট সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থলসীমান্ত পথে তা অনায়াসে ভারতে পাচার করে থাকে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেট বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে সোনার চালান প্রথমে পাঠায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এখানে নামার পর বিমানবন্দরে পর্যটন করপোরেশনের কাউন্টার, বাথরুম, টয়লেট, বিএফসিসির উচ্ছিষ্ট খাবার, মলমূত্রের ট্রলি, বিমানের হ্যাঙ্গার, কার্গোর গোডাউনসহ বিভিন্ন স্থানে সোনা লুকিয়ে রাখা হয়। এরপর বিমানবন্দরে কর্মরত ৬টি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে এ সোনার চালান বাইরে চলে আসে। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সবচেয়ে বেশি সোনার চালান পাচার হয় এ কে ট্রেডার্স ও নাহিদ ট্রেডার্সের ময়লা বহনকারী ট্রলির মাধ্যমে। আর সংস্থা দুটির ড্রেস পরিহিত ক্লিনাররাই এসব সোনা পাচারের মূল ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করছে।

সবার সমন্বয়ে ১৬ শীর্ষ সিন্ডিকেট : সোনা চোরাচালানের অভিযোগে সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানের আটককৃত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডিজিএম, পাইলটসহ ৫ জন রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। বাংলাদেশ বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের বেশ কজন কর্মকর্তার জড়িত থাকার তথ্যও বেরিয়ে আসে তদন্তে। বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণ ও গোয়েন্দা তদন্তে সোনা চোরাচালানের মূল হোতা হিসেবে ১৬ রাঘব বোয়ালকে চিহ্নিত করা হয়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সিন্ডিকেট প্রধানরা বাংলাদেশি নাগরিক হলেও তারা প্রায় সবাই সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছে দুবাইয়ে। তারা পরিবার-পরিজন নিয়েই সেখানে স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছেন। সিন্ডিকেটের দেশি এজেন্টরা তাদের পাঠানো সোনা ভারত সীমান্তে পৌঁছে দেয়। এ ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন স্থলসীমান্ত পয়েন্ট হয়ে সোনা পাচার হলেও ইদানীং ঢাকা-কলকাতা রুটে চলাচলকারী আন্তর্জাতিক ট্রেনের মাধ্যমেও ব্যাপকহারে সোনা পাচারের ঘটনা ঘটছে।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সোনা চোরাচালান সংক্রান্ত একাধিক মামলার তদন্তে নেমে দেখতে পায়, শীর্ষ ১৬ সোনা চোরাচালানির নেতৃত্বেই দেশে ১৬টি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বিমানবন্দরে ৯টি, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে তিনটি ও সিলেটে একটি সিন্ডিকেট সক্রিয়। অন্যদিকে কেবল রাজধানীর তাঁতিবাজার স্বর্ণপট্টি কেন্দ্রিক আরও দুটি সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তাদের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত রয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আরও সাতটি চোরাচালান সিন্ডিকেট। ডিবি সূত্র বলছে, সোনা চোরাচালানের কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে থাকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিভিন্ন পর্যায়ের অর্ধ শতাধিক কর্মী। ক্লিনার থেকে ঝাড়ুদার, ফ্লাইট স্টুয়ার্ড, কেবিন ক্রু, বিমানবালা, পাইলট, কো-পাইলট, ক্যাপ্টেন, ফ্লাইট সার্ভিসের বেশির ভাগ কর্মকর্তা, এমনকি শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাও সোনা চোরাচালানে সহযোগিতা দিয়ে নিজেরা আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন।

কারা চক্রের হোতা? : শুরুতে এক শ্রেণির অসাধু মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী এ দেশে সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটের জন্ম দেয়। এমরান মানি এক্সচেঞ্জের এমরান একটি সিন্ডিকেটের হোতা। তিনি দুবাইয়ে ব্যবসার পাশাপাশি সোনা চোরাচালানে জড়িত। মাসুম আল আজাদ ওরফে সুমন হচ্ছেন আরেক সিন্ডিকেটের হোতা। রাজধানীর উত্তরা এলাকায় অন্তত সাতটি মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে তার। দুবাইয়ে অবস্থানকারী বাংলাদেশ সিন্ডিকেটের অন্যতম হচ্ছেন শফিউল আজম তালুকদার ওরফে মিন্টু। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। আটটি মানি এক্সচেঞ্জের মালিক ও কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেট। অনিক মানি এক্সচেঞ্জের জাকির, ভাই-ভাই মানি এক্সচেঞ্জের টিপু, ঢাকা মানি এক্সচেঞ্জের আলী নেওয়াজ, প্যারামাউন্ট মানি এক্সচেঞ্জের জাহাঙ্গীর মিয়া এবং জাকির মানি এক্সচেঞ্জের বাকাউল হক ও বাইতুল মিয়া এ সিন্ডিকেটের সদস্য। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা অফিস রয়েছে বিমানবন্দরের অদূরেই, উত্তরায়। সোনা চোরাচালানের আরেকটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কর্ণধার সোনা রফিক। বিমানবন্দর সংলগ্ন আশকোনা এলাকায় তার বাড়ি। আগে একই সিন্ডিকেটের সহযোগী থাকলেও বাড্ডার গোল্ডেন মনির ও উত্তরখানের সোনা শফি এখন পৃথক পৃথক সিন্ডিকেট গড়েছে। রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা হওয়ায় তাদের সিন্ডিকেট দুটি এখন রমরমা অবস্থায়। এ ছাড়াও উত্তরা থেকে বনানী পর্যন্ত এলাকায় সুমন, নাছির, নিজাম, হারুন অর রশীদ, ট্রাভেলস অ্যান্ড টুরস প্রতিষ্ঠানের মালিক মোশাররফ হোসেন, সাঈদ গ্র্যান্ড সেন্টারের মেহেদী হাসান, এইচ প্লাজার হারুনর রশীদ, আব্বাস, হাছান, পিন্টু শাহীনসহ অন্তত বিশজনের নাম সোনা পাচার চক্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। তারা দুটি পৃথক সিন্ডিকেটে বিভক্ত থাকলেও যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করে থাকে। চোরাচালান নিয়ে যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে এ দুটি সিন্ডিকেটের ৫০ কোটি টাকার যৌথ তহবিল রয়েছে বলেও চাউর আছে।

গত দুই বছরে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে ব্যাপকহারে সোনা চোরাচালান হওয়ার ঘটনায় দেশের শীর্ষ পর্যায়ের সব গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ নজরদারি শুরু হয়। ফলে ঢাকা বিমানবন্দরে কড়াকড়ি আরোপ করায় সোনা চোরাচালানিরা নতুন পথ বেছে নেয়। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে সোনার প্রচুর চালান ঢুকছে। ঢোকার পর তা নদী, সড়ক ও ট্রেনপথে ঢাকায় এনে বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কুমিল্লায় ৩৫টি সোনার বারসহ দুজন গ্রেফতার : কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, ৩৫টি সোনার বারসহ মো. মিলন (২৭) ও কফিল উদ্দিন (২০) নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে কুমিল্লার দাউদকান্দি থানা পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দির টোল প্লাজা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। দাউদকান্দি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু ছালাম মিয়া জানান, ঢাকাগামী একটি মাইক্রোবাসে তল্লাশি করে সোনার বারগুলো ঢাকা নিয়ে যাওয়ার পথে কুমিল্লার দাউদকান্দির টোল প্লাজায় দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার মিলনের বাড়ি ফেনী সদরের অশ্বদিয়া রানীরহাট ও কফিল উদ্দিনের বাড়ি একই জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার দক্ষিণ কুহুমা গ্রামে।

সর্বশেষ খবর