রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
সোনা জব্দ, মামলা, গ্রেফতার হয় চোরাচালানি

থাকে না বন্দী, হয় না শাস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

থাকে না বন্দী, হয় না শাস্তি

সোনা চোরাকারবারিরা গ্রেফতার হলেও তাদের ধরে রাখা যায় না। আইন আদালতে তাদের কারও শাস্তিও নিশ্চিত করা যায়নি। অদৃশ্য ক্ষমতাবলে, নানান ঘাট মাড়িয়ে শিগগিরই তারা বেরিয়ে আসেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে দুটি বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চোরাপথে আসা প্রায় ৪৬ মণ সোনা আটক হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৩৭ ব্যক্তিকে আটক করা হয়, বিভিন্ন সংস্থা মামলা করে ১৪২টি। ধৃত ব্যক্তিদের অধিকাংশই জামিনে বেরিয়ে গেছেন। কোনোভাবেই তাদের জেলে আটকে রাখা সম্ভব হয় না। কোনো মামলার একজন আসামি হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর ওই মামলার অন্য আসামিরা সেই জামিন আদেশ দেখিয়ে নিম্ন আদালত থেকে জামিন নিচ্ছেন। এ ছাড়া এসব মামলার তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই।

মণে মণে সোনা উদ্ধার, ডজন ডজন মামলা ও আটকের পরও বন্ধ হয়নি সোনা চোরাচালান। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ পর্যন্ত আটক হয়েছে যত সোনা, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সোনা পাচার হয়েছে নিরাপদে। নিত্যনতুন কৌশল, রুট পরিবর্তন করে সোনা চোরাচালান হচ্ছে। কখনো শরীরের ব্যান্ডেজে, কখনো পায়ুপথে, হুইল চেয়ারে, জুতা, স্যান্ডেল, বেল্ট, সাবান কেস, ল্যাপটপের ভিতর— নানা অদ্ভুত কায়দায় সোনা পাচার চলছেই। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯ সালে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার হাতে চোরাচালানের পৌনে ১২ কেজি সোনা ধরা পড়ে। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৯ কেজি, ২০১১ সালে ৪ কেজি, ২০১২ সালে প্রায় ২৪ কেজি ধরে পড়ে। আর গত বছর এ সোনার চোরাচালান ধরা পড়েছে কয়েক গুণ। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে সাড়ে ৫০০ কেজি সোনা আটক করা হয়েছে। এসব সোনার আনুমানিক দাম ৬৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। আর এর সঙ্গে জড়িত ১৮ ব্যক্তিকে আটক করা হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ৪১৪ কেজি ১৭০ গ্রাম সোনা আটক হয়; যার আনুমানিক দাম ১৮৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এ সময় আটক হয়েছেন ৩৭ জন। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত জব্দ করা ২২৭ কেজি ৭৩৮ গ্রাম সোনার দাম ১১৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা আর আটক হয়েছেন ৩৮ জন। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে প্রায় ৬৫০ কেজি সোনা আটক হয়, গ্রেফতার হয়েছেন ৪৪ জন। এর পরও প্রতিদিনই আসছে সোনা, আটক হচ্ছে ঢাকার শাহজালালে, নয় তো চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে। শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দেশের বিমানবন্দর দিয়ে যে পরিমাণ যাত্রী আসা-যাওয়া করে তাদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশকে স্ক্যানিং করা সম্ভব হয়। শুল্ক গোয়েন্দাসহ বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বরতরা সুনির্দিষ্ট তথ্য কিংবা সন্দেহের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন যাত্রীদের তল্লাশি করতে পারেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যখন-তখন যে কোনো যাত্রীর দেহও তল্লাশি করা যায় না। ফলে যে পরিমাণ সোনা বিমানবন্দর দিয়ে পাচারের সময় আটক করা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ সোনা পাচার হয়ে যাচ্ছে। চোরাকারবারিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব্ব, নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের আন্তবনিবনা ও তাদের সঙ্গে পাচারকারীদের বনিবনা না হওয়ায় মাঝেমধ্যে সোনার চালান ধরা পড়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা হয়রানি ও চাকরি হারানোর ভয়ে সোনার চোরাচালান ধরার সাহস পান না বলে সংশ্লিষ্ট কয়েক পদস্থ কর্মকর্তা জানান।

ভারতীয়দের শাস্তির দৃষ্টান্ত : সোনা পাচারকারী দেশি চোরাকারবারিরা আটক হন, মামলাও চলে আদালতে কিন্তু কাউকে শাস্তি দেওয়ার নজির নেই। তবে এ দেশে ভারতীয় সোনা চোরাকারবারিদের শাস্তিবিধানের দৃষ্টান্ত রয়েছে। ভারতের পাঁচ নাগরিক আদালতে সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকায় যশোরের আদালত তাদের প্রত্যেককে তিন বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও এক মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া সোনা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতেও বলা হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত এ পাঁচ আসামি যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। যশোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ তৃতীয় আদালতের বিচারক আলমাস হোসেন মৃধা গত ৮ নভেম্বর এ রায় দেন। মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২২ জুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ২৬ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা যশোর-বেনাপোল সড়কে একটি বাসে তল্লাশি চালান। ওই সময় এ পাঁচ ভারতীয়কে আটক করা হয়। পরে তাদের কাছ থেকে ৩৬টি সোনার বার উদ্ধার করেন বিজিবি সদস্যরা, যেগুলোর ওজন ৪ কেজি ৪০০ গ্রাম। উদ্ধার করা সোনার বাজার মূল্য প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশি টাকা, ভারতীয় রুপি ও দুবাইয়ের দিরহামও উদ্ধার করা হয়।

সর্বশেষ খবর