শিরোনাম
রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কেন্দ্র দখল ও সিল মারার শঙ্কা

কর্মকর্তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ ইসি, গণমাধ্যমে শর্তারোপ চায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

গোলাম রাব্বানী

কেন্দ্র দখল ও সিল মারার শঙ্কা

ভোটের আগের রাতে ভোটকেন্দ্র দখল ও ব্যালট পেপারে সিল মারার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বে-আইনি অস্ত্র জব্দ করা গেলে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলেও মনে করছেন নির্বাচন কমিশনাররা। তবে ভোটকেন্দ্র দখলের চেষ্টা হলে তাত্ক্ষণিকভাবে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে রিটার্নিং অফিসারদের। প্রথম বারের মতো দলীয়ভাবে পৌর নির্বাচন হওয়ায় বড় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা মাঠে রয়েছেন। এতে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এ ছাড়া পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ডেকে গতকাল বিক্ষুব্ধ নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষোভ ঝেড়েছে। নির্বাচনে আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমূলক অবস্থান, দায়িত্ব পালনে অবহেলাসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ নিয়ে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা। আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে সমন্বয় সভায় মাঠ কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দিয়ে সিইসি বলেছেন—দায়িত্ব নিয়েছেন, দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, আর যাতে বলতে না হয়। সিইসির এমন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে রিটার্নিং অফিসার, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন। অন্যদিকে পৌর নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ি হওয়ার শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে। নির্বাচনী মাঠে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট স্বল্পতা রয়েছে। এজন্য মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা নিজস্ব নিরাপত্তা ছক তৈরির অনুমতিও চেয়েছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা ভোটগ্রহণের দিন গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার ও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে শর্তারোপ করতে ইসির প্রতি অনুরোধ জানান। গতকাল আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয়ে জানা গেছে। রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে সকাল ১১টার দিকে সোয়া ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা এ বৈঠক চলে। রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে নির্বাচন কমিশনাররা, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার ভিডিপি, গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সব রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ডেকে এনে গতকাল ক্ষোভ ঝেড়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসির নির্দেশনা পালন না করাসহ নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন কর্মকর্তারা। ইসির পক্ষে থেকে এ পর্যন্ত ৪০টির বেশি অভিযোগ মাঠকর্মকর্তাদের খতিয়ে দেখতে বললেও তারা কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না তাও জানতে চায় ইসি। বৈঠকে বিক্ষুব্ধ একজন নির্বাচন কমিশনার কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, মিডিয়াতে বিভিন্ন ধরনের খবর আসছে, অথচ রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমরা কোনো খবর পাই না। পত্রিকা দেখে আমাদের জানতে হয়। মাঠে কোনো কিছুই হচ্ছে না বলে রিটার্নিং কর্মকর্তারা যে চুপ রয়েছেন তাও ঠিক নয়। কোনো দিক থেকেই সঠিক খবর আসছে না। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে ওই নির্বাচন কমিশনার বলেন, আপনারা দায়সারা ভাবে কাজ করবেন তা হবে না। এটা আপনাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। কেউ যদি মনে করেন— কোনোরকমে নির্বাচনটা পার করে দিব, তাহলে ভুল করবেন। যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন না, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব। নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, সবারই প্রশ্ন নির্বাচন কেন ভালো হচ্ছে না? নির্বাচন কমিশন তো কারও পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে না। তারপরও কেন নির্বাচন ভালো হচ্ছে না? এ নির্বাচনে যেন সেই রকম কোনো কথা থেকে না যায়, যা মানুষ শুনতে চায় না। আইনশৃঙ্খলা বিষয় সমন্বয় সভায় মাঠ কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন—দায়িত্ব নিয়েছেন, দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, আর যাতে বলতে না হয়।

সিইসির এমন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে রিটার্নিং অফিসার, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মাঝপথে সিইসি বিদেশ সফরে থাকায় কঠোর সমালোচনায় পড়েন। এবার স্বল্প সময়ে দলভিত্তিক পৌর নির্বাচন করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়েন ইসি। প্রচারণার শুরু থেকেই মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় প্রার্থীদের ব্যাপক বিধিভঙ্গের সমালোচনার ঝড়ও উঠে বিভিন্ন মহলে। সিইসি বলেন, আপনাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য এসেছে সব কিছু ঠিক ঠাক আছে। এটা যেন ঠিক থাকে। সেই দিকে তত্পর থাকতে হবে। কোনোভাবেই যেন দুষ্কৃতকারীরা প্যারামিটারের ভিতরে না আসতে পারে।

কেন্দ্র দখলের আশঙ্কা প্রকাশ করে ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভোটের আগের রাতে যেন কেন্দ্র দখল না হয়, ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে রাখা না হয়, সেই দিকে সজাগ থাকতে হবে। আগে থেকে সব খবর রাখতে হবে। বেআইনি অস্ত্র জব্দ করা গেলে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণে থাকে। সন্ত্রাসীদের ধরার নামে নিরপরাধ ব্যক্তিরা যাতে হয়রানির শিকার না হন সে বিষয়ে নজর দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই বৈঠকে রাজশাহী ও রংপুরে জঙ্গি তত্পরতার আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে। জনসমাবেশ টার্গেট হতে পারে। এই ধরনের কোনো পরিস্থিতি যেন না ঘটে সেদিকে আমরা সজাগ থাকব। এ সময় আইনশৃঙ্খলা সদস্যদের তিনি বলেন, এই সুযোগে সর্বশক্তি দিয়ে এদের আয়ত্তে আনতে হবে। মিডিয়া প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, খবরের কাগজে অতি রঞ্জিত করে লেখা হচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকে সঠিক বিষয়টি তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে। প্রমাণ পেলে অ্যাকশন নিতে হবে। ওখান থেকে অ্যাকশন না নিলে ইসি থেকে সেভাবে অ্যাকশন নেওয়া সম্ভব হয় না। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা অ্যাকশন নেবেন এবং মিডিয়াকেও জানাবেন।

গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, স্থানীয় সরকার যথা পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে প্রার্থী বেশি থাকায় প্রতিযোগিতা বেশি হয়। এতে নির্বাচনের পরিবেশ মসৃণ থাকে। বিপরীত দিকও রয়েছে, অতি প্রতিযোগিতার কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে ঝুঁকি থাকে। নির্বাচনে জনবহুল পরিবেশ (ক্রাউড) সৃষ্টি হয়। জঙ্গিরা এ ধরনের পরিবেশকে টার্গেটে রাখে। জঙ্গিদের ইস্যু মাথায় রেখে ব্যবস্থা নিতে হবে।

তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক রয়েছে। ভোটগ্রহণের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, তত বড় দলগুলোর মধ্যে কোন্দল বেড়ে যেতে পারে। নির্বাচনের সুযোগে ফেরারি আসামিরা বেরিয়ে নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া এ নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ি হতে পারে। এসব প্রতিরোধে চলমান সন্ত্রাস বিরোধিতা জোরদার করতে হবে। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে—নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র্যাবের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। ভোটের দিন র্যাবের বেশ কিছু টিম ঢাকায় প্রস্তুত থাকবে। কোথাও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা দেখা দিলে গাড়ি বা হেলিকপ্টারযোগে ফোর্স পাঠানো হবে। এ ছাড়া ডগ স্কোয়াড ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট প্রস্তুত থাকবে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে—ভোটের দিন টেলিভিশনগুলোতে সকাল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করায় ছোটখাটো বিষয়গুলো প্রচারিত হয়। ওই সব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই মিডিয়ার কল্যাণে সবাই জেনে যায়। পরবর্তীতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হলেও নির্বাচনের বদনাম হয়। এ জন্য সাংবাদিকদের জন্য গাইডলাইন দিতে ইসির প্রতি অনুরোধ জানান।

এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশ্যে সিইসি বলেন, গণমাধ্যম আমাদের একটি ফোর্স। এটিকে আমাদের কাজে লাগানো যেতে পারে। সরাসরি সম্প্রচার হলে আমরা কমিশনে বসে কোন কেন্দ্রে কী হলো তা দেখে ব্যবস্থা নিতে বলতে পারি। তিনি বলেন, আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অপরাধে রিটার্নিং কর্মকর্তারা যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছেন তা মিডিয়াতে প্রকাশ পেলে অন্যরা সচেতন হবে। এ ছাড়া সভায় পৌর নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যানরা প্রভাব বিস্তার করছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

ইসির তদন্ত প্রতিবেদন দুই মন্ত্রী বক্তব্য দিলেও বিধি ভাঙেনি : ময়মনসিংহের ফুলপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর সভায় দুই মন্ত্রী বক্তব্য দিলেও তারা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই পথসভার মাধ্যমে প্রচার চালানোর চেষ্টা করায় মেয়র প্রার্থীকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমে আসার পর ১০ ডিসেম্বর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। ইসির আচরণবিধি প্রতিপালন সংক্রান্ত মনিটরিং কমিটির একজন সদস্য বলেন, এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে দুই মন্ত্রীর আচরণবিধি ভঙ্গের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তথ্যমন্ত্রী ও ধর্মমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের যে অভিযোগ এসেছে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। ওই এলাকায় নির্বাচনী সমাবেশের পাশ দিয়ে দুই মন্ত্রী তাদের গন্তব্যস্থলে যাচ্ছিলেন, তখন তাদের ডেকে বক্তব্য দিতে বলা হয়। ফলে দুই মন্ত্রী বক্তব্য রাখেন। তবে ওই বক্তব্যে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের মতো কিছু ছিল না।

চাটখিলের তদন্ত প্রতিবেদন আজ : নোয়াখালীর চাটখিল পৌরসভায় বিএনপি প্রার্থীকে জোর করে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে। বিএনপির এ অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ইসির আইন শাখার উপসচিব ওই এলাকায় গিয়ে তদন্ত করছেন। তদন্ত কর্মকর্তাকে আজ ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনার  মো. শাহনেওয়াজ জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর