নিষিদ্ধ ও মানহীন ভেজাল ওষুধ সেবনের ফলে কিডনি ও লিভারের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এ ওষুধে মানুষের মস্তিষ্ক চিরদিনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, ভেজাল ওষুধ ব্যবহারের ফলে ভবিষ্যতে শরীরে ওষুধের কার্যকরী ক্ষমতা হারিয়ে যেতে পারে। এমনকি এসব ওষুধ সেবনের ফলে চিরদিনের মতো যৌনহানিসহ মৃত্যুও ঘটতে পারে। এ ছাড়া নিম্নমানের ওষুধ ব্যবহারে রোগী ভালো না হয়ে দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার মধ্যেও পড়ে থাকেন। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওষুধের দোকানে নামে-বেনামে বিভিন্ন ক্ষতিকর ওষুধ বিক্রি হচ্ছে দেদার। এসব দোকানে চটকদার মোড়কে ভয়াবহ ক্ষতিকর আমলকি প্লাস, যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট মুনিস, স্টিমুলার, ফ্যামেগ্রা বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়াও সারভিটাল, সারডিগুল, আই ক্যাল এম, আইক্যাল বি, ভিটাফার্ড ডিএসসহ হরেক নামের নিম্নমানের ক্ষতিকর ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন বিক্রি হচ্ছে অবাধে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এ ওষুধগুলোতে রয়েছে উচ্চ মাত্রার ক্ষতিকর এস্ট্ররয়েড। এসব ওষুধ হূিপণ্ড ও কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক চিকিৎসক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভেজাল ওষুধ সেবনে একদিকে রোগের উপসর্গ কমে না, অন্যদিকে যে রোগের জন্য ওষুধটি খাওয়া হলো তা নিয়ন্ত্রণে না এসে রোগীর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটায়। স্বাস্থ্য সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, ভেজাল ওষুধের প্রসার রোধে জেলা পর্যায়ে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে ওষুধে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। দেশব্যাপী ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের জনবল স্বল্পতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় কাজ করছে, সেক্ষেত্রে তাদের জনবল কম হওয়ার কথা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ ও প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জানান, অনুমোদনহীন কিছু ওষুধ কোম্পানি ভেজাল ও নকল ওষুধ বিক্রি করছে। এর সঙ্গে যে ওষুধগুলোর কাটতি বেশি, অসাধু ব্যবসায়ীরা সে ওষুধের প্রয়োজনীয় ও নির্দিষ্ট কাঁচামালের পরিবর্তে নিম্নমানের পদার্থ মিশিয়ে আসল ওষুধের প্যাকেট বা নাম দিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করছেন। ব্যবসায়ীরা সাধারণত মুনাফালোভী চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই এ ধরনের অপকর্ম করেন। শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সিরাজুল ইসলাম বলেন, কিছু ভিটামিন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, যা খেলে কোনো উপকার হয় না। বরং মানবদেহের ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে এসব বেনামি প্রতিষ্ঠানের ভিটামিন বা অন্য ওষুধ কীভাবে ডাক্তাররা লেখেন সে বিষয়ে নজরদারি করা উচিত। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, ওষুধের মানের বিষয়ে নিশ্চিত হতে হলে সরকারি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করতে হবে। মান পরীক্ষা করতে চাইলে বিদেশেও ওষুধ পাঠানো যেতে পারে। দেখা যায়, অনেক ওষুধ আছে তা একজনের খুব ভালো কাজ করে, আবার অন্যজনের করে না। অর্থাত্ ওষুধের কার্যক্ষমতা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিডিএস) খুলনা জেলা সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, ল্যাবরেটরি পরীক্ষা ছাড়াই বিক্রি হওয়া বিভিন্ন ওষুধ বিশেষ করে যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট-ক্যাপসুল স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। নিষিদ্ধ এসব ওষুধ সাময়িক সুস্থতা বা শরীরের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করলেও তা কিডনি ও মস্তিষ্ককে চিরদিনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তিনি আরও বলেন, নিষিদ্ধ ওষুধগুলো বাজার থেকে তুলে নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে ওষুধ অধিদফতর থেকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তারা তা আমলে নিচ্ছে না। মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডা. আবদুল হালিম বলেন, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ মানুষ সেবনে বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘস্থায়ী রোগের পাশাপাশি মৃত্যু ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়টি সিভিল সার্জনের মাধ্যমে জেলার ড্রাগ সুপার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তিনি ড্রাগ সুপারের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মশিয়ার রহমান বাবু জানান, ভেজাল ওষুধ সেবনের ফলে কিডনি নষ্টসহ চিরদিনের মতো যৌনহানির আশঙ্কা, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মাসুদ রানা বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলায় অলিতে-গলিতে গড়ে ওঠা হারবাল চিকিত্সা কেন্দ্র থেকে নিম্নমানের ওষুধ দেওয়া হয়। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া দেশি-বিদেশি কোম্পানির নামে বাজারে যেসব ফুড সাপ্লিমেন্ট বা ভিটামিন পাওয়া যায়, এর বেশির ভাগই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এসব ওষুধ সেবনের কারণে কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হতে পারে। কিশোরগঞ্জের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও জেলা বিএমএর সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার নৌশাদ খান বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধে একজন ক্রেতা একদিকে যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে তিনি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও পড়ছেন। কারণ এসব ওষুধ কোনো উপকারে আসে না। এসব ওষুধে কিডনি সমস্যাসহ নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতিটা হবে তা হলো, এসব ওষুধ ব্যবহারের ফলে ভবিষ্যতে শরীর ওষুধের কার্যকরী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আবদুল হাকিম বলেন, নামসর্বস্ব কোম্পানিগুলোকে সরকার লাইসেন্স দেওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও আমরা এ ব্যাপার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। তিনি বলেন, ওষুধের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় হতে হবে। তার মতে, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে রোগীদের হাতুড়ে ডাক্তার থেকে দূরে থাকতে হবে। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে।