কোনো রোডম্যাপ নয়, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ দেওয়ার সময় এসে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, এখন নির্দিষ্ট একটি তারিখ দেওয়া যুক্তিযুক্ত ও ভালো সিদ্ধান্ত হবে। সেটা ডিসেম্বর-জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি-মার্চ যাই হোক। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে সংস্থাটির কার্যালয়ে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফাহমিদা খাতুন। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উপস্থিত ছিলেন। বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলে। রাজনীতিতে যদি স্থিতিশীলতা না থাকে, তাহলে বিনিয়োগ আসবে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। তখন দারিদ্র্য অনেক বেড়ে যাবে। তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাচনের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্বাচন হয়ে গেলেই যে বাংলাদেশ দ্রুত প্রবৃদ্ধির জগতে ঢুকে যাবে-বিষয়টি এমন নয়। অনেক কিছু আছে যেটা আমাদের করতে হবে। আমরা যদি ব্যাংকিং ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের সংস্কার ভালোভাবে করতে পারি, তাহলে এটার ফলাফল আমরা পরবর্তীতে পাব। তিনি বলেন, এখন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগ হবে বিষয়টি এমনও নয়। আমাদের এখানে বিনিয়োগ না আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে, গ্যাস দিতে পারছি না। অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক যে সেবাগুলো রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, সেটাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এগুলো করার জন্য তো নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। খাতগুলোকে আধুনিকায়ন করতে কি আমাদের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন আছে?
এদিকে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সিপিডির পর্যালোচনায় রাজস্বের ঘাটতির তথ্য জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন তার প্রবন্ধে জানিয়েছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব বৃদ্ধি মাত্র ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। যা লক্ষ্য পূরণের জন্য বাকি সময়ে প্রায় ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি দরকার, যা অসম্ভব। মার্চ পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের যে হিসাব সিপিডি করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে।
মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি
সিপিডির দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এটাকে বাড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম চালক হিসেবে কাজ করেছে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, বন্যা, দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনার প্রভাব, আমদানি ব্যয়, সবকিছু মিলিয়ে আমাদের মুদ্রাস্ফীতির বেড়েছে। গ্রামে খাদ্য ও বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেশি আবার শহরে সেটা সামান্য বেশি। ২০২৩ সালে ৭০ হাজার কোটি টাকার মুদ্রা সরবরাহ করা হয়েছিল। সেটার জন্য মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি।
সিপিডির গবেষণার তথ্যানুযায়ী, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে চলতি মাস থেকে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতি ধীরগতিতে কমলেও আগামী বছরের মার্চ মাস থেকে কিছু নির্দিষ্ট কারণে সেটা আবার বেড়ে যাবে।
ঋণখেলাপির পরিমাণ দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের চেয়েও বেশি : ব্যাংকিং খাতে মূলধন কমতি, খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি, দ্বৈত নিয়ন্ত্রণের কারণে এ খাতে সংকটের কারণ বলে সিপিডি তার প্রতিবেদনে জানিয়েছে। সিপিডি বলছে, ঝুঁকি মোকাবিলা করতে যে শক্তিমত্তা প্রয়োজন সেটা দুর্বল হয়ে রয়েছে। ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২০৬ বিলিয়ন টাকা আর সেটা ২০২৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৫৭ বিলিয়ন টাকা। অর্থাৎ দুই বছরে এটা দ্বিগুণের বেশি গিয়েছে। এই ভয়াবহ ঋণখেলাপির পরিমাণ দেশের বার্ষিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের চেয়েও অনেক বেশি, যা অর্থনৈতিক সম্পদের মারাত্মক অপচয় ও অপব্যবহারকে নির্দেশ করে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতকে রাজনীতিমুক্ত করা, আইনি ফাঁকফোকর বন্ধ করা ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।
বৈদেশিক খাতে ফিরছে স্থিতিশীলতা, তবে বিনিয়োগে ধীরগতি : সিপিডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, চলমান ২০২৫ অর্থবছরে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও বৈদেশিক খাতে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ফলে বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমেছে এবং চলতি হিসাব ভারসাম্য উন্নত হয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে, যা এখন স্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে।
পুঁজিবাজারে গতি ফিরছে না : সিপিডি জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ৯ মাসে দেশের পুঁজিবাজার প্রত্যাশিত গতিতে অগ্রসর হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের অনিয়মের প্রভাব এবং চলমান সংস্কার উদ্যোগের ধীর বাস্তবায়নই এই স্থবিরতার প্রধান কারণ। গত ৯ মাসে কোনো নতুন কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) নিয়ে বাজারে আসেনি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও আইপিও তালিকাভুক্তির সুযোগকে সীমিত করেছে।
জ্বালানির দাম বাড়ায় মানুষ চাপে পড়েছে : বাংলাদেশ ভয়াবহ জ্বালানি সংকটে রয়েছে বলে জানিয়েছে সিপিডি। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশীয় গ্যাস উৎপাদন হ্রাস, ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি ও অব্যবস্থাপনার কারণে শিল্প, কৃষি ও গৃহস্থালি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনও গ্যাস ঘাটতিতে ব্যাহত হচ্ছে, ফলে লোডশেডিং বেড়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষও চাপে পড়েছে। সিপিডি দ্রুত গ্যাস অনুসন্ধান, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ ও জ্বালানি অবকাঠামো আধুনিকায়নের সুপারিশ করেছে।