বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশ থেকে ১ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ২ লাখ ১৯ হাজার ৬০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। পাচারের টাকায় একজনই কিনেছেন ৩৫০টি বাড়ি। দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের প্রধান অতিথি হিসেবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গভর্নর এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে গতকাল অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম। প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন বিএফআইইউ পরিচালক মুহাম্মদ আনিছুর রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও বিএফআইইউর উপপ্রধান মো. কাওছার মতিন, মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান, কমিউনিকেশনস অ্যান্ড পাবলিকেশনস বিভাগের পরিচালক (চলতি দায়িত্বে) মহুয়া মহসীনসহ সংশ্লিষ্টজন।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পাঁচ-সাত বছর লেগে যেতে পারে। বিপুল অঙ্কের পাচার করা এই অর্থ উদ্ধারে বিদেশিদের সাহায্য পাচ্ছি। যারা দেশের বাইরে টাকা পাচার করেছে তাদের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। তবে কারা এবং কীভাবে ও কোথায় এসব অর্থ পাচার করেছে, সে বিষয়ে আর কিছু বলেননি তিনি। গভর্নর বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পূর্ব অভিজ্ঞতা নাই। তাই এখন আন্তমন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেজন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা সংশোধন করবে সরকার। অর্থ পাচার ছাড়াও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এতে আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষিত থাকবে। গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। আমানতকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ তারা একটি শক্তিশালী ব্যাংকের অংশ হয়ে যাবেন। এ সময় গ্রাহকের টাকা সুরক্ষিত রয়েছে উল্লেখ করে তিনি ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন না করার আহ্বান জানান। তিনি আরও জানান একীভূতকরণের আগে ব্যাংক রেজল্যুশন ফান্ড গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তহবিল সংগ্রহ করবে। ব্যাংক রেজল্যুশন আইনের মধ্যে থেকেই ব্যাংক একীভূত করা হবে। তাতে ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে প্রতিবন্ধকতার মুখে ফেলা হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট জব্দ করেনি।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিন দিন অর্থ পাচারের পরিমাণ বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংক খাতে মোট ১৭ হাজার ৩৪৫টি সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রমসংক্রান্ত প্রতিবেদন (এসটিআর/এসএআর) বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) দাখিল হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২২ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। ব্যাসেল অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং (এএমএল) ইনডেক্স-২০২৪-এ বাংলাদেশের অবস্থান ১৩ ধাপ উন্নীত হয়ে এখন ৫৯-এ হয়েছে, যা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির নির্দেশক। বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম বলেন, গত অর্থবছরে বিএফআইইউ মোট ১১৪টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন (ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টস) বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থায় পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে আইনপ্রয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২২০; যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি।
বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া। তবে আমরা বিশ্বব্যাংকের এসএলএআর, ইউএসডিওজে, আইএসিসিসি, আইসিএআরের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নিচ্ছি। পাশাপাশি বিদেশি আইনি সংস্থা নিয়োগের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিএফআইইউ সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’