সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

গুলশানে অবৈধ হোটেল রেস্টুরেন্টের ছড়াছড়ি

সংখ্যা ছাড়িয়েছে দুই হাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক

অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশানে অসংখ্য অবৈধ হোটেল রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য স্থাপনা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এতসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ধকলে কূটনৈতিক এলাকাটি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। সেখানে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় তা কখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ২০০৮ সালের জরিপে জানা যায়, পুরো গুলশানে ৯০৪টি আবাসিক প্লটে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। আরেক অভিজাত এলাকা বনানীতে রয়েছে এ ধরনের ৩৯৯টি প্রতিষ্ঠান। তবে গত আট বছরে এ সংখ্যা বেড়ে এখন দুই হাজার ছাড়িয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। গুলশান আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় একদিকে অস্বাভাবিক যানজট বেড়েছে, অন্যদিকে বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা।

ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী ও বারিধারায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েও বারবারই পিছু হটেছে রাজউক। জঙ্গি হামলার আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আবারও সরকার অবৈধ স্থাপনাগুলো শিগগিরই উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বরাবরের মতোই রাজউক কর্মকর্তারা ঢিমেতালে পথচলা শুরু করায় উচ্ছেদের কার্যক্রম অনিশ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে রাজউক বলছে, গত কয়েকদিন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার তালিকা হালনাগাদ করার কার্যক্রম চলছে। এটি শেষ হলেই উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করা হবে। গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই কূটনৈতিক এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। তিনি বলেন, আবাসিক এলাকায় কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রাখা হবে না। প্রাথমিকভাবে গুলশান, বনানী ও বারিধারার আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা হোটেল-রেস্তোরাঁ দিয়ে অভিযান শুরু হবে বলে জানান মন্ত্রী। এসব এলাকার স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালগুলো সরাতে তিন মাস সময় দেওয়া হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে তাদের জন্য নতুন জমি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এক্ষেত্রে রাজউকের উত্তরা ও পূর্বাচল প্রকল্পের কথাও ভাবা যেতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার ফলে রাজধানীর এই অভিজাত এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। একেকজন বিপুল অর্থ খরচ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাবশালীরা নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় উচ্ছেদ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এ প্রসঙ্গে নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, রাজউকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি আজকের ঢাকাকে এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে। তার মতে, নগর পরিকল্পনার কোনো নিয়মই ঢাকায় মেনে চলা হয়নি। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। রাজধানীর গুলশান বারিধারা বহু বছর আগেই আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে। সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনার পর ওই এলাকার নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সেখানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শত শত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সেখানকার অনুমোদনহীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। গুলশানের অনেক বাসাবাড়িতেই গড়ে উঠেছে বিউটি পার্লার, ছোট মার্কেট, গার্মেন্ট, হাসপাতাল, কোচিং সেন্টার, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। সঙ্গে ছোট-বড় দোকানপাট তো আছেই। গুলশান শুটিং ক্লাব থেকে গুলশান-২ নম্বর গোল চত্বর পর্যন্ত এভিনিউ সড়কের পাশের প্লটগুলোতে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। এর বাইরে কোনো প্লটের বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। গুলশানের ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৪১, ৪২, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৫১, ১০৩, ১০৯, ১১১, ১২৬, ১৩৩, নম্বর সড়কে শতাধিক প্লটে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। গুলশান-১-এর ২০ নম্বর সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, ওই সড়কে ছোট-বড় আকৃতির ২০টি দোকান গড়ে উঠেছে। গুলশান-১-এর ১৫/বি প্লটে ফুলের দোকান গড়ে তোলা হয়েছে। গুলশান ১১/এ-এর ৯২ নম্বর সড়কে গড়ে তোলা হয়েছে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি। বারিধারায় আমেরিকান দূতাবাসের ঠিক সামনেই নানারকম ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। ইট, বালু, খোয়ার ব্যবসা থেকে শুরু করে নার্সারির নামে ঘন ঝোপঝাড় গড়ে তোলা হয়েছে। উল্টোপাশেই সরকারি জায়গা জবর দখল করে কয়েকশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে প্রগতি সরণিতে। এসব উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত কখনো সফল হয়নি। সম্প্রতি রাজউক হাতিরঝিল থেকে গুলশান-শাহজাদপুর লিংক রোড পর্যন্ত লেকপাড় ঘেঁষে চমৎকার একটি রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। লেক ঘেঁষা রাস্তাটিতে প্রায়ই বিদেশিরা সপরিবারে পায়ে হেঁটে বেড়ান। কিন্তু লেক সংলগ্ন বাড্ডা এলাকায় রাস্তাটির বেশিরভাগ জায়গা জবর দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেছে প্রভাবশালীরা। সেখানে রাত-দিন দখলবাজ সন্ত্রাসীরা আড্ডাবাজিতে মেতে থাকে। বিদেশিদের চলাফেরার ক্ষেত্রে এ রাস্তাটিও এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। গুলশানে ৫৫২টি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রাজউক। অনুমোদন ছাড়াই গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হোটেল-রেস্তোরাঁ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালও রয়েছে। রাউজকের চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী বলেন, আমরা চূড়ান্ত এ তালিকা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে জমা দেওয়ার পর এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে করণীয় ঠিক করা হবে। এর আগে বৃহস্পতিবার গুলশান, বনানী ও বারিধারার আবাসিক এলাকার অবৈধ হোটেল-রেস্তোরাঁ উচ্ছেদে শিগগিরই অভিযান শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। দুই সপ্তাহ আগে গুলশানের এক রেস্তোরাঁয় নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার পর অভিজাত এ এলাকার অননুমোদিত স্কুল-কলেজ, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও হাসপাতাল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ঈদের ছুটি শেষে প্রথম কর্মদিবসে রবিবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে গুলশান ও আশপাশের এলাকায় অননুমোদিত স্থাপনাগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের আবাসিক প্লট ও ভবন থেকে সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরাতে ছয় মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর