সোমবার, ৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

মালয়েশিয়াজুড়ে আতঙ্ক

চলছে ধরপাকড়। পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি আটক। ঘরে ঘরে উৎকণ্ঠা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

মালয়েশিয়াজুড়ে আতঙ্ক

মালয়েশিয়ায় গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন দুই লাখের বেশি অবৈধভাবে অবস্থান করা বাংলাদেশি। অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশিদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া সরকারের সাঁড়াশি অভিযানে সে দেশে ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে আতঙ্ক। আর এই আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশিদের। কারণ মালয়েশিয়ায় থাকা প্রায় ছয় লাখ অবৈধ কর্মীর অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশি। তিন লাখের বেশি অবৈধ অবস্থানকারীর বাংলাদেশি মাত্র ৭১ হাজার বৈধ হওয়ার জন্য মালয়েশিয়া সরকারের দেওয়া সুযোগ গ্রহণ করতে নিবন্ধন করেছেন। বাকি দুই লাখের বেশি অবৈধ বাংলাদেশি এখন গ্রেফতার আতঙ্কে দিশেহারা। আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না তারা। যাচ্ছেন না কাজে। কিন্তু তাতেও রক্ষা নেই। তীব্র অভিযানে নামা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হুটহাট ব্লক-রেড দিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে প্রত্যেকের কাগজপত্র চেক করছে। কাগজপত্র ঠিক না থাকলেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কারাগারে। শুক্রবার রাত থেকে শুরু হওয়া এই তীব্র অভিযানে প্রথম দিনই ৫১৫ বাংলাদেশি গ্রেফতার হয়েছেন। গতকাল আরও কয়েক হাজার বাংলাদেশি গ্রেফতার হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে তৈরি হওয়া গ্রেফতার আতঙ্কে ফাঁকা হয়ে গেছে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলো। প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম।

মালয়েশিয়ার পেনাং থেকে বাংলাদেশি প্রবাসী ব্যবসায়ী সালমান সাদী টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আগে কিছু নির্দিষ্ট এলাকার রাস্তাঘাটে এত বেশি বাংলাদেশি থাকতেন যে স্বাভাবিক হাঁটাচলা করা কঠিন হয়ে যেত। এখন সেই সব রাস্তাঘাট পুরো ফাঁকা। কাজকর্মে যাওয়া তো দূরের কথা, কেউ এখন প্রয়োজনীয় কোনো কিছু কিনতেও দোকানপাটে যাচ্ছে না। সাদী জানান, মালয়েশিয়া সরকার ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশি শ্রমিকদের বৈধকরণের জন্য সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু অনেকেই এ সুযোগ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন। অনেকেই এ সুযোগ গ্রহণে অনাগ্রহীও ছিলেন। আবার অনেকে দালালের মাধ্যমে নিবন্ধনের জন্য টাকা দিয়েও করতে পারেননি। স্বাভাবিক সময়ে মালয়েশিয়ার পুলিশ অবৈধদের ধরলে ৫০ রিঙ্গিত ঘুষ নিয়ে আবার ছেড়ে দিত বলেই এত বেশিসংখ্যক অবৈধ নিবন্ধনের সুযোগ গ্রহণ করেননি বলে অভিমত এই বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর। তিনি বলেন, ‘গ্রেফতার আতঙ্কে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দুই দিন ধরে কোনো কাজ হচ্ছে না। কর্মীদের সবাই বাংলাদেশি হওয়ায় তারা কেউ আসছেন না।’ মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যাবসা করা চীনা ব্যাবসায়ীরা দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান চালানোর কর্মীর অভাবে ইতিমধ্যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন বলেও জানান সালমান সাদী।

মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন দফতরের মহাপরিচালক মুস্তাফার আলীর বরাত দিয়ে মালয়েশিয়া স্টার পত্রিকা জানিয়েছে, প্রথম দিন দেশটির ১৫৫টি এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোট এক হাজার ৩৫ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আটকদের মধ্যে ৫১৫ জন বাংলাদেশি, ১৩৫ জন ইন্দোনেশীয়, ১০২ জন ফিলিপিনো, ৫০ জন থাই ও দুজন ভিয়েতনামি নাগরিক রয়েছেন। আটকদের মধ্যে ১০১ জন নারী ও তিনটি শিশুও রয়েছে। নিয়ম ভেঙে অবৈধ অভিবাসীদের কাজে রাখায় ১৬ জন চাকরিদাতাকেও আটক করা হয়েছে। মালয়েশীয় ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালককে উদ্ধৃত করে মালয়েশিয়ার ডেইলি সান বলেছে, আটকরা ই-কার্ডের জন্য আবেদন না করার বিভিন্ন রকম কারণ দেখিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তারা আবেদনের সময়সীমা জানতেন না। আবার কেউ বলেছেন, ওই সময়সীমা বাড়ানো হবে বলে চাকরিদাতারা তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যম দ্য স্টারের খবরে বলা হয়েছে, অভিবাসন কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক দাতুক সেরি মুস্তাফার আলী নিজেই একাধিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন। কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর সায়েদুল ইসলাম জানান, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বৈধ কাগজপত্রহীন শ্রমিকদের বৈধভাবে পুনর্নিয়োগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চার মাস ধরে ই-কার্ডের আবেদন নেওয়া হয়। ৩০ জুন শেষ হয় এই সুযোগ। এই ই-কার্ডের মেয়াদ আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অর্থাৎ যাদের কাছে বৈধ পাসপোর্ট বা কাজের অনুমতি নেই, ওই ই-কার্ড হাতে থাকলে তারা ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় থেকে কাজ করতে পারবেন। ওই সময়ের মধ্যে তাদের নিজ নিজ দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট ও ট্রাভেল ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে নতুন করে ওয়ার্ক পারমিট নিতে হবে। তা না হলে নির্ধারিত সময়ের পর তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ। দেশটির অভিবাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থান করছেন প্রায় ৬ লাখ শ্রমিক। কিন্তু নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ নিয়েছেন মাত্র মাত্র ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা ৭১ হাজার ৯০৩ জন। এর পরই রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার (২৬ হাজার ৭৬৪ জন) ও মিয়ানমারের (১১ হাজার ৮২৫ জন) নাগরিক। অবৈধ অভিবাসীদের নিবন্ধনের চিত্রে হতাশ ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক মুস্তাফার আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ই-কার্ড নিবন্ধনের সময়সীমার ওপর আমি বহুবার জোর দিয়েছিলাম। এখন অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু হবে এবং তাদের নিয়োগদাতাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। এমনকি যারা স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আসা লোকদের চাকরি দিয়েছে, তারাও রেহাই পাবে না।’ তিনি জানান, মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি অবৈধ শ্রমিক বসবাস করছে বাংলাদেশের। এরপর ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও নেপালের নাগরিক রয়েছেন। কুয়ালালামপুর থেকে বাংলাদেশি আকাশ আহমেদ জানান, মালয়েশিয়ায় এর আগে দেওয়া বৈধ হওয়ার সুযোগে দালালদের হাতে লাখ লাখ রিংগিত দিয়ে প্রতারিত হয়েছিলেন হাজার হাজার শ্রমিক। তাই এবার সরকার এক বছরের জন্য অস্থায়ী কার্ড (ই-কার্ড) করার সুযোগ দিলেও অনেকেই সে বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকার এবার খুবই কঠোর অবৈধ শ্রমিকদের ব্যাপারে। ই-কার্ড করতে নিবন্ধনের মেয়াদ শুক্রবার শেষ হওয়ার পর থেকেই ধরপাকড় শুরু হয়েছে। এবার অবৈধ শ্রমিক ধরতে পুলিশ প্রতিটা ঘরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ঢাকার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব জাভেদ আহমেদ বলেন, অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে গ্রেফতার প্রক্রিয়া মালয়েশিয়া সরকারের নিয়মিত কার্যক্রম। সেখানে চার লাখ বাংলাদেশি কর্মী বৈধভাবে কর্মরত আছেন। তাদের নিয়েই সরকার চিন্তা করে। অবৈধদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়ার নিয়ম মানার বাইরে কিছু করার নেই। তবে এটাও ঠিক মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিকের ডিমান্ড রয়েছে। একশ্রেণির প্রতারক চক্র অবৈধ শ্রমিক পাঠায়, যাদের বৈধ কাগজপত্র থাকে না।

মালয়েশিয়ার আইন অনুসারে, কোনো অবৈধ শ্রমিক যদি কোম্পানি থেকে গ্রেফতার হয় তাহলে মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়াও জরিমানা করা হবে। ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার রিংগিত জরিমানা হবে। অন্যদিকে আদালতের নির্দেশে জেল-জরিমানার পর অবৈধ শ্রমিককে এক থেকে সর্বোচ্চ ছয়টি রোতান (বেত্রাঘাত) দেওয়া হবে।  পরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে নিজ দেশে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর