রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

চাপের মুখে অর্থনীতি

পর্যালোচনায় বৈঠক ডেকেছেন অর্থমন্ত্রী

মানিক মুনতাসির

চাপ বাড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা পরিস্থিতি, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ, শেয়ারবাজারের নিম্নগতি, প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক ধারা, মূল্যস্ফীতির চাপ ঊর্ধ্বমুখী, ডলারের সংকট, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি প্রভৃতি কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এক ধরনের চাপের মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটকে সামনে রেখে বাজেট সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি সভা ডাকা হয়েছে। একই সঙ্গে সংকট পর্যালোচনা এবং পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে আগামী ২৪ এপ্রিল আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠক ডেকেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আবার রোজা শুরুর আগেই বেড়েছে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম। সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ে চলছে ধীরগতি। এডিপির অর্থ খরচ করতে না পেরে ফেরত পাঠাচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট ঘোষণার মাত্র দুই মাস আগে অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই রয়েছে নেতিবাচক ধারায়। সামষ্টিক অর্থনীতির এসব সংকটের মাঝেও আগামী বাজেটের রূপরেখা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন অর্থমন্ত্রীর সামনে প্রথম বাজেটটি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামষ্টিক অর্থনীতির কল্যাণে কয়েকটি বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। যে কোনো উপায়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে, অন্যথায় ব্যাংক খাত গভীর সংকটে পড়বে। এ অবস্থায় বহির্বিশ্বের শ্রমবাজারগুলো কীভাবে পুনর্গঠন করা যায় এবং নতুন শ্রমবাজারের অনুসন্ধান করা ও বেসরকারি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়াতে টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন খুবই জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। ডলার সংকট : চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ডলার বাজার। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সময়মতো বিদেশি ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে গুনতে হচ্ছে জরিমানা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাজারে ডলার ছাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতেও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। প্রায় প্রতি দিনই ডলারের দাম বাড়ছে। কমছে টাকার মান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলার এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৪ টাকা ১৫ পয়সায়। গত মাসের শেষদিকেও প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা। তবে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম আরও চড়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৮৬ টাকায়ও পর্যন্ত ডলার বিক্রি হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, রপ্তানি, রেমিট্যান্স আয়ের সঙ্গে আমদানি ব্যয়ের একটা অসামঞ্জস্য হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এর ফলে দামও বাড়ছে। আর চাহিদা অনুযায়ী ডলারও দিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে প্রায় ১৬০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এরপরও ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। অথচ গত বছরের মে-জুনেও প্রতি ডলার ৮৩ টাকা ৭০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। বাড়ছে মূল্যস্ফীতি : চাল, ডাল, মাছ, মাংস, সবজিসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে গত বছরের তুলনায়। বেড়েছে পরিবহন খরচ এবং বাসা ভাড়াও। ফলে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ দাঁড়ায়। মার্চে তা আরেক দফা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশে। আগামী মাসেই রোজা। ধারণা করা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বমুখী চাপ এই মুহূর্তে কমিয়ে আনা কঠিন। বরং সামনের দিনগুলোতে এই চাপ আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি খেলাপি ঋণ : ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ইতিহাসের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এক বছরে খেলাপি ঋণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। এর আগে বছরে কখনো এত বেশি বাড়েনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এটি মোট ঋণের ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ হয়েছিল ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ওই সময়ে ব্যাংকগুলো ৮ লাখ ৬৮ হাজার সাত কোটি টাকা বিতরণ করেছিল। আর রাইট অফ (অবলোপন) করা ঋণ খেলাপি ঋণের সঙ্গে যোগ করলে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকই রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের। গত ২৭ নভেম্বরের এক বৈঠকের কার্যপত্রে খোদ অর্থবিভাগ বলছে, সরকারি মালিকানাধীন এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংকের সম্পদ ও মূলধনের বিপরীতে আয় ঋণাত্মক যা সামগ্রিক আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে পারে।

ডুবছে শেয়ারবাজার : দেশের উভয় শেয়ারবাজারে চরম আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে হতাশাগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক প্রতিদিনই কমছে। গত তিন মাসে ডিএসইর বাজার মূলধন প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা কমেছে। শুধু গত সপ্তাহের চার-পাঁচ কর্মদিবসেই বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা যা বিনিয়েগাকীরদের চরম সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। রাজস্ব ঘাটতি ৩৪ হাজার কোটি টাকা : চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এবিআর) রাজস্ব আদায়ে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে। এ জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব করেছিল এনবিআর। তবে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের সরবরাহ ঠিক রাখার কথা মাথায় রেখে এনবিআরের দাবি প্রত্যাখ্যান করে ১৬ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। এদিকে আগামী অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হবে। রপ্তানি আয় বাড়লেও কমছে প্রবাসী আয় : রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়লেও অব্যাহতভাবে কমছে প্রবাসী আয়। তার চেয়েও দ্রুত গতিতে কমছে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর হার। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে তিন হাজার ৯০ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবাসী আয় কমেছে। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। গত জানুয়ারি মাসে প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠিয়েছিলেন ১৫৯ কোটি মার্কিন ডলার, যা ফেব্রুারিতে কমে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩১ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার। উন্নয়ন ব্যয়ে ধীরগতি : সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ে বিরাজ করছে ধীরগতি। বিশেষ করে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ ফার্স্টট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পের কাজের গতি কমেছে সাম্প্রতিক সময়ে। গত ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে এ বিষয়ে একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অর্থবিভাগ। কাজের ধীরগতির কারণে চলতি অর্থবছরের বরাদ্দের অর্থ ফেরত পাঠাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এ জন্য সামনের দিনগুলোতে এসব প্রকল্পের কাজের গতি বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করে অর্থবিভাগ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি অনেক দিন ধরেই স্থিতিশীল। তবে গত দু-এক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। প্রবাসী আয় কমছে। সরকারের রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি রয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। এসব ক্ষেত্রে একটা নিয়ন্ত্রণ দরকার। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সামগ্রিক কার্যক্রম আরও জোরদার করা প্রয়োজন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর