বুধবার, ২০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার এডিপি

যত ঝড়ঝঞ্ঝা আসুক মোকাবিলা করতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনা দুর্যোগের মধ্যে আরেক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড়। এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছে। যতই ঝড়ঝঞ্ঝা আসুক, বাধা আসুক কাটিয়ে উঠতে পারব। এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারব। গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) সভায় যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা বারবার সক্ষমতা দেখিয়েছি। তাছাড়া আমরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছি। তিনি বলেন, জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ হবে। শুরু থেকেই আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের মতো দুর্যোগ চলে এলো। এরপর আবার ঘূর্ণিঝড়। যতই আঘাত আসুক, ঝড়ঝঞ্ঝা আসুক, বাধা আসুক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমস্যা চিরদিন থাকে না। এক সময় নিশ্চয়ই এটা কাটিয়ে উঠতে পারব।

২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন : সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গ্রহণ করেছে। ১ হাজার ৫৮৪টি প্রকল্পের জন্য এই অর্থ ধরা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় গতকাল নতুন এডিপি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এনইসি সভায় যোগ দেন এবং সভায় সভাপতিত্ব করেন। এ ছাড়া সভায় গণভবন থেকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান অংশগ্রহণ করেন। অন্যদিকে এনইসি সভায় শেরেবাংলানগর থেকে অংশগ্রহণ করেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, মূল এডিপি ছাড়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা করপোরেশনের ৮৯টি প্রকল্পে প্রায় ৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার এডিপিও অনুমোদন করেছে এনইসি। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসহ সরকারের এডিপির সর্বমোট আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা প্রায়। দারিদ্র্য নিরসন ও জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্য সামনে রেখে সরকার প্রতিবারের মতো এ বছরও দেশজ সম্পদ, বৈদেশিক অর্থায়ন ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এডিপি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। এডিপির সফল বাস্তবায়ন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এবারের এডিপিতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া ১০টি খাত হচ্ছে ১. পরিবহন, ২. অবকাঠামো, পানি ও গণপূর্ত, ৩. বিদ্যুৎ, ৪. শিক্ষা ও ধর্ম, ৫. বিজ্ঞান, তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি, ৬. পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান, ৭. স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ, ৮. কৃষি, ৯. পানিসম্পদ, ১০. জনপ্রশাসন। যা মোট এডিপির ৯৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতসহ সরকারের চলমান ৭ মেগা প্রকল্পকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবারের এডিপি। আর সেভাবেই তৈরি হবে সরকারের নতুন অর্থবছরের বাজেট। এর আগে ১২ মে পরিকল্পনা কমিশনের বর্ধিত সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সভাপতিত্বে ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন এডিপিতে ১০টি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পরিবহন খাতে (সড়ক ও সেতু মিলিয়ে) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫২ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যা চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি। অবকাঠামো, পানি সরবরাহ ও গণপূর্ত খাতকে দ্বিতীয় গুরুত্ব দিয়ে এই খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ২৫ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে বিদ্যুৎ খাত। ১২ দশমিক ০৯ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে খরচ হবে ২৪ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। চতুর্থ স্থানে রয়েছে শিক্ষা ও ধর্ম। এ খাতে বরাদ্দ ২৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ। বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে মোট বরাদ্দ ১৮ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান খাতে বরাদ্দ ১৫ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় খাতে বরাদ্দ ১৩ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। কৃষি খাতে বরাদ্দ ৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ। পানিসম্পদ খাতে বরাদ্দ ৫ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। জনপ্রশাসন খাতে বরাদ্দ ৪ হাজার ৪৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

সরকারের চলমান সাত মেগা প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বরাদ্দ ৫ হাজার কোটি টাকা। মেট্রোরেল প্রকল্পে বরাদ্দ ৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। মহেশখালী মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে বরাদ্দ ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে ৩৫০ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পে বরাদ্দ ১৫০০ কোটি টাকা।

এদিকে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, বরাদ্দ পেয়েছে ৩১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, বরাদ্দ পেয়েছে ২৪ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ বরাদ্দ পেয়েছে ২৪ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে ১৭ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। রেলপথ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে ১২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বরাদ্দ পেয়েছে ১০ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ বরাদ্দ পেয়েছে ৯ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে ৯ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। সেতু বিভাগ বরাদ্দ পেয়েছে ৭ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে ৬ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা।

১০ মাসে উন্নয়ন বাজেটে খরচ ৯৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা : চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৪৯.১৩ শতাংশ খরচ করেছে, যা টাকার অংকে ৯৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। গতকাল এনইসি সভা শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রী এক ব্রিফ করে এসব তথ্য জানান। মন্ত্রী জানান, করোনা পরিস্থিতির মুখে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এডিপির ৪৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, যা গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। হাতে এ অর্থবছরের দুই মাস বাকি আছে। পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, ১০ মাসে টাকা ভালো ব্যয় করেছি, তবে করোনাভাইরাস না থাকলে আরও ভালো করতাম। গত বছর এই সময়ে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৫৪.৯৪ শতাংশ, যা টাকার অংকে ৯৭ হাজার ৩০ কোটি।  আসন্ন অর্থবছরে কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, আমরা এবারের এডিপিতে স্বাস্থ্য ও কৃষিতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। স্বাস্থ্য খাতে ২ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দিয়েছি। কৃষি খাতেও ১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দিয়েছি।  প্রধানন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে এম এ মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, দেশের প্রয়োজন বিবেচনায় যে কোনো সময় বরাদ্দ বাড়ানো যাবে। আপনারা প্রকল্প নিয়ে আসুন জনকল্যাণমুখী হলে অনুমোদন দেওয়া যাবে।

সর্বশেষ খবর