শিরোনাম
শনিবার, ১১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগের সবখানেই সাহেদদের বিচরণ

আওয়ামী লীগের উপকমিটি ছাত্রলীগসহ সব সংগঠনে হাইব্রিডদের জয়জয়কার

রফিকুল ইসলাম রনি

আওয়ামী লীগের সবখানেই সাহেদদের বিচরণ

টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় সাহেদরা আওয়ামী লীগের সবখানে ঠাঁই করে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপকমিটি, সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন এই সাহেদরা। জীবনে কখনো ছাত্রলীগের রাজনীতি কিংবা জয়বাংলা স্লোগান না দিলেও আওয়ামী লীগের কিছু কেন্দ্রীয় নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সখ্য গড়ে তুলে বনে গেছেন উপকমিটি সদস্য কিংবা সহযোগী সংগঠনের নেতা। কেউ কেউ গত ১১ বছরে বিশেষ আশীর্বাদে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে কিংবা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে। টেন্ডার থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসাও বাগিয়ে নিয়েছেন তারা। অথচ আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে যেসব ছাত্রনেতা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, জামায়াত-বিএনপির নির্যাতন সহ্য করেছেন, জেল খেটেছেন তাদের অনেকের ঠাঁই হয়নি বিভিন্ন উপকমিটি কিংবা সহযোগী সংগঠনে। পাপিয়া, পাপুল ও সাহেদ কান্ড ধরা পড়ার পর জোরালো হচ্ছে আওয়ামী লীগকে হাইব্রিডমুক্ত করতে আন্দোলন গড়ার ডাক।

সূত্র মতে, সাহেদরা কীভাবে রাষ্ট্রীয়  গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেতেন, কার কার সঙ্গে তাদের সখ্য সেগুলোর অনুসন্ধান করা হচ্ছে। দলের পরিচয়ে যে কেউ যেন টকশোতে অংশ নিতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।

নব্বইয়ের গণআন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা শফি আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাহেদ গংরা আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারের কোথায় নেই! খুঁজলে সবখানে পাওয়া যাবে। ১১ বছরে এরা সবখানে বিরাজমান। এদের কারা প্রমোট করেছে? কারা গণভবন, বঙ্গভবনে ঢুকিয়েছে? সেসব হিসাব নেওয়ার সময় এসেছে। নইলে বঙ্গবন্ধুকন্যা কতটা নিরাপদ! সেটা কি আওয়ামী লীগ নেতারা একবার ভেবেছেন? এই সাহেদ গং, পাপুলরা দেশের সুনাম নষ্ট করছে। এর দায় কী তারা এড়াতে পারবে? এখনো সময় আছে হাইব্রিড, সুবিধাবাদীদের বিদায় করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাবেক নেতাদের দল ও সহযোগী সংগঠনে মূল্যায়ন করার। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের অনুপ্রবেশকারীদের এবং যারা দলের নাম ভাঙ্গিয়ে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন তাদের দল থেকে বের করে দেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাহেদকে যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে তাদের চিহ্নিত করা উচিত এবং অতিদ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সাহেদরা কীভাবে দলের ভিতর কোন দরজা দিয়ে ঢোকে, সেই দরজা অবশ্যই বন্ধ করে দিতে হবে। 

সাবেক ছাত্রনেতারা দাবি তুলছেন, সাহেদরা যে দরজা দিয়ে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে সে দরজা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে এক দিন খাঁটি আওয়ামী লীগারদেরই হাইব্রিডরা বের করে দেবে। 

গত সপ্তাহে হাসপাতালে করোনাভাইরাস টেস্ট ও চিকিৎসার নামে প্রতারণাসহ ৩২টি মামলার আসামি রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ। তিনি আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য হিসেবে নানা জায়গায় পরিচয় দিতেন। আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য পরিচয় ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, টকশোবিদ। এক দিনও সাংবাদিকতা না করে তিনি হয়ে ওঠেন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। এই দাপটে তিনি ভয়ঙ্কর অপরাধ করে বেড়িয়েছেন। দল ও সরকারের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে বিশেষ সখ্য থাকায় কখনো মেজর, কখনো প্রধানমন্ত্রীর এপিএস, কখনো সাংবাদিক নেতা পরিচয় দিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা বলছেন, সাহেদ, পাপুল ও পাপিয়ারাই শুধু নয়, এমন সংখ্যা কত? গোনায় শেষ হবে না। দল টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কাঠামোয় অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের সময়ে অনুপ্রবেশ বেশি ঘটে দলে। কিছু কেন্দ্রীয় নেতা নিজেদের প্রকোটল বাহিনী বড় করতে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নেতাকে দলে ভেড়ান। কখনই তাদের রাজনৈতিক খতিয়ান দেখেননি। কেউ কেউ বিশেষ সুবিধা নিয়েও পদ-পদবি দিয়েছেন। কিংবা সহযোগী সংগঠনের পদ দিতে বাধ্য করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন উপকমিটির বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এলেও তিনি কখনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু বিগত উপকমিটিতে তার নাম রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সভা- সেমিনারে তার সরব উপস্থিতি ছিল।

সাবেক ছাত্রনেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপকমিটি ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদ-পদবিতে সাহেদ মার্কা নেতাদের প্রাধান্য বেশি। কারণ যারা শীর্ষ নেতাদের কাছে চামচামিতে পারদর্শী। কিছু কিছু নেতাও এটা ভালো পছন্দ করেন। এই হাইব্রিড নেতারা বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে মানুষকে ব্ল্যাক মেইল করছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা বীর আবু আব্বাস ভুইয়া। সাহেদ গংদের অপকর্ম ধরা পড়ার পর নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘ধামরা তো কোনো মহোদয় বা বড় নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলতে পারি না (ইচ্ছাও করে না, ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই)!! আমরা তো গণভবন, বঙ্গভবন, রাষ্ট্রীয় সরকারি প্রোগ্রামের দাওয়াত কার্ড পাই না। ১ম সারিতে বসার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমাদের শরীরে ঘামের গন্ধ, গাড়ি নেই, দামি পারফিউম নেই, দামি কাপড়চোপড় নেই, অঢেল টাকা নেই। সাহেদরা পারে, কারণ তাদের যোগ্যতা আছে!! আমরা অচল মাল! আমরা অযোগ্য!’

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সরকার মামুন-অর-রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি যাকে পিটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিয়েছিলাম সে এখন আওয়ামী লীগের অফিসে ঘুর ঘুর করে। এই সাহেদদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন, তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। শুধু এক সাহেদই নয়, আরও সাহেদ নেতাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে। ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুল কবির রাহাত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দলের দুঃসময়ের কর্মীদের মূল্যায়ন না হলে রাজনীতির মাঠে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। চাটুকার, বাটপাড়রা জায়গা করে নেয়। তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য দলের নাম ব্যবহার করে বদনাম করে। যারা নেতৃত্বে থাকেন তাদের দুঃসময়ের কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ দুঃসময়ের কর্মীরা অভিমানী হয়। তারা নেতার বাসার নিচে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। চাটুকারিতা করে না। দামি দামি উপহার দেয় না। এখনো সময় আছে হাইব্রিড, টাউট বাটপাড়দের বাদ দিয়ে ত্যাগী ও পরীক্ষিত সাবেক ছাত্রনেতাদের মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ দুঃসমেয়র কর্মীরা দলের বদনাম হয় এমন কোনো কাজ করে না।

সর্বশেষ খবর