সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

অগ্রগতি হয়েছে বোঝাও বাড়ছে

------- শিরিন হক

অগ্রগতি হয়েছে বোঝাও বাড়ছে

স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দেশের সব মানুষ কী    পেল সেটা যেমন ভাবতে হয় একইভাবে দেশের নারীরা কতটা এগিয়ে গেছে তা নিয়েও আমাদের ভাবতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই অনেক ক্ষেত্রেই নারীর অগ্রগতি হয়েছে। আর তা স্বীকার করতেই হবে। তবে নারীর অগ্রগতি হচ্ছে এ কথা যেমন সত্য এর পাশাপাশি নারীর বোঝাও বাড়ছে। নারীপক্ষের সদস্য এবং প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক শিরীন হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

এই নারীনেত্রী বলেন, দেশে নারীর গড় আয়ু বেড়েছে। যা বিশাল অগ্রগতি। এমনকি মাতৃমৃত্যুহার যতটা কমে যাওয়া প্রয়োজন ছিল তা যদি নাও কমে থাকে, যতটাই কমেছে তাও বড় প্রাপ্তি। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। এখন সবাই চায় মেয়েরা লেখাপড়া করুক। প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলে-মেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে এখন পরিবেশগত কোনো পার্থক্য নেই, বরং এক্ষেত্রে মেয়ে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আছে। এমনকি শিক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রেও মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। এগুলো বিশাল অর্জন।

শিরীন হক বলেন, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। গৃহকাজের পাশাপাশি এখন বিপুলসংখ্যক নারী বাইরে এসেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। কিন্তু বিপরীতে ছেলেরা ঘরের কাজে তেমন একটা এগিয়ে আসছে না। এ অবস্থায় নারীদের দ্বিগুণ কাজ করতে হচ্ছে।  ছেলেরা যদি বাইরে কাজ সামলানোর পাশাপাশি ঘরের কাজও করত তাহলে সমতা আসত। সমাজে এই পরিবর্তন এখনো হয়নি, এটি হলে বলা যেত নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। এখন নারীর অগ্রগতি হচ্ছে কিন্তু এর পাশাপাশি নারীর বোঝা বাড়ছে, নারীর কর্মঘণ্টা বাড়ছে।

তিনি বলেন, নারীরা এখন এমন অনেক খাতে কাজ করছে যা অতীতে তাদের জন্য উপযুক্ত মনে করা হতো না। অপ্রচলিত পেশায় নারীর প্রবেশ ঘটেছে। যেমন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গাড়িচালক, ট্রেনচালক ও পাইলট হিসেবে আগে নারীদের কাজ করার কথা ভাবা না হলেও এসব জায়গায় এখন নারীদের কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই নারী তার জন্য নির্ধারিত গন্ডি ও সীমানা অতিক্রম করছে। আবার পুঁজি খাটিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রেও মেয়েরা এগিয়ে আসছে। স্বল্প পুঁজির ব্যবসা থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ও নারীর অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। সাংস্কৃৃতিক অঙ্গন, সাংবাদিকতা এবং খেলাধুলায়ও নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।

শিরীন হক বলেন, যে খাতগুলোতে নারীরা এগিয়ে গেছে সে খাতগুলোতে আবার চ্যালেঞ্জও আছে। এই যে নারী প্রথাগত পেশার বাইরে প্রবেশ করছে তা নারীর জন্য সহজ হচ্ছে না। প্রতিদিনই নারীকে এক ধরনের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এই লড়াই যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং বৈষম্য মোকাবিলায় করতে হচ্ছে।

একদিকে নারী বাধা-বিপত্তি ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু নারীর এগিয়ে যাওয়ার পর এই অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষায় যে সহায়ক পরিবেশের প্রয়োজন এবং এ জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণের দরকার তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। এসব সহায়ক পদক্ষেপগুলো যাতে উপস্থিত থাকে তা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের তথা সরকারের। নারীদের নিজের অবস্থানকে ধরে রাখার জন্য বাড়তি যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এমনও দেখেছি একজন নারীকে উচ্চপদস্থ কোনো দায়িত্ব দেওয়ার পর তার জন্য পরিবেশ এত অসহনীয় করে তোলা হয় যে, সেই নারী সে জায়গা থেকে চলে আসতে বাধ্য হন। 

এই নারীনেত্রী বলেন, নারীর প্রতি যৌন হয়রানিসহ যে সহিংসতা হচ্ছে তা নিয়ে এখন আর কেউ চুপ থাকছে না। একসময় বিষয়গুলো নারীর জন্য সংকোচ বা লজ্জাজনক বলে মনে করা হলেও সেই ধারণাগুলো এখন ভাঙছে। এ কারণে এ ধরনের ঘটনাগুলোও আগের চেয়ে আমাদের সামনে বেশি আসছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এবং নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতার মাত্রা কতটা বাড়ছে তা চিহ্নিত করতে দেশে কোনো সমীক্ষা নেই। প্রতিদিন নারী খুন হচ্ছে, সহিংসতার শিকার হচ্ছে- তাহলে এটিকে কেন জরুরি অবস্থা হিসেবে সরকার বিবেচনা করছে না, এটি  আমাদের প্রশ্ন। এর কারণ, আমাদের নীতিনির্ধারকরাও বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। মেয়েরা মার খাবে এটিই যেন স্বাভাবিক ব্যাপার! কিন্তু এর ব্যাপকতা বিচার করে সরকারকে বিষয়টিতে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। আমার মতে, আইন করে এ ধরনের অপরাধ ঠেকানো যাবে না। আইনের কাজ অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া কিন্তু সমস্যার সমাধান আইন করতে পারে না। এ সমস্যা সমাধানে ব্যাপক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দরকার। এ জন্য বিশাল উদ্যোগ ও শিক্ষার সম্প্রসারণ প্রয়োজন। প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিটি প্ল্যাটফরম, তা ডিজিটাল বা নন-ডিজিটাল যাই হোক, ব্যবহার করে এই শিক্ষার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য ঘরের ভিতর থেকে শুরু করে সব জায়গায় মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।

শিরীন হক মেয়েদের আরও সাহসী হতে এবং যে কোনো স্থানে অপমানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে, সব অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর