সোমবার, ২৪ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

কথায় কথায় খুনোখুনি

আধিপত্য বিস্তার দখল চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা মাদক ব্যবসা ও কিশোর গ্যাং

সাঈদুর রহমান রিমন

কথায় কথায় খুনোখুনি

রাজধানীসহ সর্বত্রই খুনখারাবি ও নৃশংসতার ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও একের পর এক খুনোখুনি ঘটে চলছে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও জমি নিয়ে বিরোধেÑ এমন দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তবে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, দখল-বেদখল, চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা, মাদক বাণিজ্যসহ নানারকম অপরাধ তৎপরতা ঘিরে নিয়মিত খুনোখুনির এন্তার নজির রয়েছে। পাশাপাশি সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। রাজধানীর টোকাই শ্রেণির শিশু-কিশোরদের হাতেও চকচকে ঝকঝকে আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি থাকায় তা ব্যবহার হচ্ছে যত্রতত্র। এসব কারণে জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলছে অপরাধ দৌরাত্ম্য। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, ঢাকায় প্রতি মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি খুনের ঘটনা ঘটছে। তবে পেশাদার খুনিরা খুব বেশি সময় গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তাদের গ্রেফতার হতে হয় বলে দাবি করেন তিনি। অতিসম্প্রতি (১৬ মে) প্রকাশ্য দিবালোকে পল্লবীতে আগাম ঘোষণা দিয়ে সাহিনুদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীকে যে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সেই ভিডিওচিত্র দেখে মানুষজন শিউরে উঠেছে। লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি এম এ আউয়ালের পল্লবী আলীনগর এলাকায় জায়গাজমি দখলবাজিকে কেন্দ্র করে তার নির্দেশে হত্যাকা-টি সংঘটিত হয়। প্রকাশ্যে জনবহুল রাস্তার ধারে কয়েকজন পেশাদার ভাড়াটে দুর্বৃত্ত ৭ মিনিট ধরে কুপিয়ে সাহিনুদ্দিনকে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত করে মোবাইল ফোনে কল করে বলে ‘স্যার ফিনিশ’। নিহত যুবককে হত্যার ব্যাপারে পাঁচ দিন আগে এই দুর্বৃত্তরা সরাসরি হুমকি দেয়। এ ব্যাপারে পল্লবী থানায় সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বেগম পাঁচ হুমকিদাতার নাম উল্লেখ করে জিডি করেন। কিন্তু এতেও তার জীবন বাঁচাতে পারেনি।

পেশাদার অপরাধীসহ পাড়া-মহল্লার ছিঁচকে মাস্তানদের আচরণেও নৃশংসতা যেন চরম আকার ধারণ করেছে। মানুষের আচরণ যেন বন্যপশুর হিংস্রতাকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। মুদি দোকানে বিক্রির পরিমাণ কম হওয়ায় শিশু কর্মচারীকে নিছক সন্দেহের বশেই হাত, পা, মুখ বেঁধে আলমিরার ভিতরে দুই দিন ধরে তালাবদ্ধ রাখার বর্বরতা চালাতেও দ্বিধা করছে না দোকানি। চা আনতে দেরি করায় গ্যারেজ কর্মচারীর হাত, পা, মুখ বেঁধে পায়ুপথে মেশিনের সাহায্যে বাতাস ভরে মেরে ফেলার নির্মমতাও ঘটেছে একাধিক। সালাম না দেওয়াকে কেন্দ্র করে মুগদা এলাকায় হাসান মিয়া নামের এক কিশোরকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। তানভীরের নেতৃত্বাধীন ‘ব্যান্ডেজ’ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এ নৃশংস খুন সংঘটিত করে। এরই মধ্যে ডিবি ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সাতজনকেই গ্রেফতারে সক্ষম

হয়েছে। রাজধানীর উত্তরায় ইফতারির দাওয়াত রক্ষা না করার ক্ষোভে বান্ধবীসহ বন্ধুকে ডেকে নিয়ে শাকিল হোসেন (২৪) নামে এক তরুণকে তারই বন্ধুরা কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করেছে। এ ঘটনায় অপর বন্ধু সাগর (২৩) গুরুতর আহত হন। ৯ মে রাতে উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। টিকটক ভিডিও নিয়ে বাদানুবাদের তুচ্ছ জের ধরেও স্বামী শান্তর হাতে খুন হয়েছেন স্ত্রী সোমা। শুধু বিচ্ছিন্নভাবেই খুনোখুনি ঘটে তা নয়, সংঘবদ্ধভাবেও পেশাদার অপরাধীরা খুনের টার্গেট করে প্রতি রাতে শহরময় ঘুরে বেড়ায়। এমন রোমহর্ষক তথ্য উদ্ঘাটন করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গামছা পার্টি নামে চিহ্নিত এ পেশাদার ডাকাত গ্রুপের হাতে খোদ রাজধানীতেই খুন হয়েছেন অন্তত ১৬ জন। সিএনজিচালক ও যাত্রী সেজে রাতে মানুষকে জিম্মি করে তারা। পরে সর্বস্ব লুটে নিয়ে হত্যার পর নির্জন স্থানে ফেলে রেখে যায় মরদেহ। সম্প্রতি রাজধানীর কুড়িল এলাকায় এ চক্রের সদস্যদের সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে দুজন। আটক করা হয়েছে অপর দুই সদস্যকে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইদানীং বেশির ভাগ নৃশংসতার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে রীতিমতো প্রকাশ্যে, শত শত পথচারীর চোখের সামনে। আবার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে নৃশংস হত্যাকা-েরও বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। আগাম হত্যার হুমকির বিষয় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে জানিয়েও ভুক্তভোগী মানুষটি নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পারছেন না। অনেক হত্যাকা-ের পর উল্লাস প্রকাশ করছে খুনিরা। ঢাকার দক্ষিণখানে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পুলিশের সামনে এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয় এবং হত্যার দৃশ্য ফেসবুক আইডি থেকে লাইভ করার মতো নৃশংসতার চিত্রও দেখতে পান মানুষজন। অপরাধীরা নিজেদের ক্ষমতা ও প্রভাবকে জানান দিতেও আগাম ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে সবার চোখের সামনে এসব অপরাধ অপকর্ম করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকিকে প্রশাসন আমলেই নিচ্ছে না, আবার অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও কারও সঙ্গে দুর্বৃত্ত চক্রের দহরম মহরম সম্পর্ক থাকায় এড়িয়ে যাওয়ার কাজটি করে বলে অভিযোগ উঠেছে। সে অভিযোগের সত্যতা প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও বাস্তবে সর্বত্রই নির্মম নৃশংসতার ঘটনা ঘটে চলছে এবং তা দেখতে পাচ্ছেন মানুষজন।

খুনখারাবিসহ কোনো অপরাধের ব্যাপারেই সহসা বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত হওয়ার নজির না থাকায় দুর্বৃত্তদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের প্রতি তোয়াক্কাহীন মনোভাব গড়ে উঠেছে বলেও মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

তারা মনে করেন, এর পেছনে অন্যতম কারণ পরকীয়া, জমি-সংক্রান্ত বিরোধ, মাদকের অর্থ জোগাড় ইত্যাদি। এ ছাড়া ইন্টারনেটের অপব্যবহার, অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে বীভৎস বিকৃত খুনের ঘটনার বেশির ভাগই ঘটছে অপেশাদার খুনিদের মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন, সামাজিক অবস্থান সৃষ্টির তীব্র প্রতিযোগিতার জের ধরেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সূত্রপাত ঘটছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই ঘটছে খুনোখুনির ঘটনা।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব খুনের ঘটনা ঘটেছে এর পেছনে পরিবারের সদস্য কিংবা আত্মীয়স্বজনদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কম বয়সী কিশোর ও যুব সম্প্রদায়ই বড় বড় অপরাধ সংঘটন করে চলছে, তাদের প্রায় সবাই মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মাদক ক্রয়ের প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে না পেরে নিজের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা বা আহত করারও বেশ কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি : রাজধানীজুড়ে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি চলছে। পেশাদার সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি অস্ত্র উঠে আসছে কথিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে হাতেও। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায়ের কতিপয় নেতা এসব অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে থাকেন এবং তা নিজের বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে পৌঁছে দেন বিভিন্ন গ্রুপ সদস্যদের হাতে। তারা রাজনৈতিক কর্মকা-ে কিংবা ওই নেতার জায়গাজমি দখলবাজির ক্ষেত্রে এসব অস্ত্রধারীকে বিশ্বস্ত কর্মীর মতোই ব্যবহার করেন। তবে বাকি সময় তারা এসব অস্ত্র ব্যবহার করে নানামুখী অপরাধের কাজে। ইতিপূর্বে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাবের পৃথক অভিযানে উদ্ধারকৃত অস্ত্রশস্ত্রের সূত্র ধরে তদন্ত চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও তা মজুদের বিস্তারিত তথ্য উদ্ঘাটনে সক্ষম হয়। সেসব তথ্যের ভিত্তিতে সরকারি দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও দফায় দফায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানকালে অন্তত ১৬টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

অবৈধ অস্ত্র আসছে সীমান্ত দিয়ে : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে অস্ত্র কারবারিরা অভিনব কৌশল গ্রহণ করে। মাঝে-মধ্যেই বদল করে অস্ত্র আমদানির রুট। সূত্রমতে, বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা বেছে নিয়েছে অস্ত্র কারবারিরা। ট্রাকবোঝাই পণ্যের ভাঁজে ভাঁজে অস্ত্রের চালান নিয়ে আসে তারা। সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে যশোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় অস্ত্র ব্যবসায়ী মাসুদের তত্ত্বাবধানে। গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে মাসুদ জানায়, সে সীমান্তবর্তী অঞ্চলেই বেশি অবস্থান করে। দেশীয় এজেন্ট হিসেবে অস্ত্র আমদানি করে থাকে। পরে পণ্যবোঝাই ট্রাকে অস্ত্রের চালান তুলে দিয়ে তার গতিপথ অনুসরণ করতে থাকে। এ ছাড়া রাজশাহী জেলার চারঘাট সীমান্ত অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের সবচেয়ে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর