রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করতে সমঝোতা স্মারকের পর এবার বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। পাশাপাশি বাংলাদেশে একটি স্থায়ী দফতর পরিচালনা করতে চায় তারা। ৩১ আগস্ট এ প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনা করতে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের এ প্রস্তাব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা করছে সরকার। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশ করে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতেও রাজি হননি সংশ্লিষ্ট কেউ।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকার এবং আইসিসির ‘অফিস অব দ্য প্রসিকিউটর (ওটিপি)’-এর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয় ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর। সমঝোতা স্মারকের মূল বিষয় ছিল রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতকরণ ঘটনার তদন্তে আইসিসি-ওটিপিকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করা। পাশাপাশি তদন্তের সুবিধার জন্য প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিবিধ ‘ইমিউনিটিস অ্যান্ড প্রিভিলেজ’ দেওয়া। এরই ধারাবাহিকতায় আইসিসি বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দিয়েছে। আগের সমঝোতা স্মারকে শুধু আইসিসির ওটিপিকে সহযোগিতায় তা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত চুক্তিতে প্রতিষ্ঠানটির সব অঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ওটিপি ছাড়াও আইসিসির আরও প্রেসিডেন্সি, বিচার বিভাগ ও রেজিস্ট্রি নামের তিনটি অঙ্গ রয়েছে। এ ছাড়া আলাদাভাবে রয়েছে ‘ট্রাস্ট ফান্ড অব ভিকটিম’, যা সরাসরি সদস্য-রাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়ে পরিচালিত। ওটিপির মূল কাজ হলো অপরাধের তথ্য যাচাই, এ-সংক্রান্ত তদন্ত ও আদালতে মামলা পরিচালনা করা। রেজিস্ট্রির কাজ হলো বিচারকদের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের আয়োজন, ভুক্তভোগীদের সহায়তা ও সাক্ষীদের সুরক্ষা প্রদান, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, আউটরিচ ও জনমত-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা। ওটিপির তদন্তকাজ সফল হলে ‘রেজিস্ট্রি’ ও ‘ট্রাস্ট ফান্ড অব ভিকটিম’-এর কাজের পরিসর সংশ্লিষ্ট মামলার ক্ষেত্রে আরও বাড়বে। এ কারণে তারা একটি সার্বিক সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের প্রস্তাব করেছে, যা বিশ্বের আরও আটটি দেশের সঙ্গে রয়েছে।
আন্তমন্ত্রণালয় সভায় বলা হয়, রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতকরণের জবাবদিহি এবং এ-সংক্রান্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘের সব প্রাসঙ্গিক সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশ অত্যন্ত সোচ্চার। এ ছাড়া রোহিঙ্গা জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যেসব বৈশ্বিক প্রক্রিয়া কাজ করছে, এর সঙ্গে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে জড়িত। এর মধ্যে আইসিসি কর্তৃক পরিচালিত বিচারিক প্রক্রিয়াও বিদ্যমান। বাংলাদেশে আইসিসি একটি স্থায়ী দফতর করতে চায় উল্লেখ করে সভায় আরও জানানো হয়, ওটিপির সঙ্গে সমঝোতা স্মারকটি শুধু ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর-পরবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত এবং তৎসংশ্লিষ্ট ঘটনাসমূহে সীমাবদ্ধ থাকলেও প্রস্তাবিত চুক্তিতে কোনোরূপ সীমাবদ্ধতা রাখা হয়নি। এ ছাড়া প্রস্তাবিত চুক্তিপত্রের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ এমন আভাস দেয় যে, আইসিসি বাংলাদেশে একটি স্থায়ী দফতর পরিচালনা করতে আগ্রহী। প্রস্তাবিত চুক্তিটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন-সংক্রান্ত বাংলাদেশের মূল লক্ষ্যের সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ বা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার বিষয়ে বক্তারা গুরুত্ব দেন।উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালের আগস্টে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। হত্যা করে নারী-শিশুসহ বহু রোহিঙ্গা মুসলিমকে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো যেটিকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে অ্যাখ্যা দেয়। ওই বছর ২৫ আগস্ট রাতে প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নাফ নদ পার হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ শুরু করে। সে সময় উদারতার পরিচয় দিয়ে অসহায় মানুষগুলোকে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ সরকার। ২০১৭ সালের আগে থেকে অন্তত লাখ চারেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়ে রয়েছে। এর পর থেকে পরের কয়েক মাসে এসেছে আরও সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশে। তাদের আশ্রয় নেওয়ার চার বছর কেটে গেলেও এখনো নিজ দেশে ফিরতে পারছে না তারা। বিষয়টি নিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের হেগে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পৃথক একটি মামলা করেছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। এরপর এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।