শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

মেট্রোরেলে প্রথম দিনে উচ্ছ্বাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

মেট্রোরেলে প্রথম দিনে উচ্ছ্বাস

মেট্রোরেলে প্রথম দিনে গতকাল যাত্রীদের মধ্যে ছিল উচ্ছ্বাস। অনেকে এ সময় সেলফিও তোলেন -রোহেত রাজীব

মেট্রোরেল চালুর প্রথম দিন ইতিহাসের সাক্ষী হতে ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতের বাধা পেরিয়ে ভোরে লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছে সাধারণ মানুষ। উৎসবমুখর পরিবেশে টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ে স্বল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পেরে আনন্দ উৎসব করেছেন যাত্রীরা।

সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে পাঁচজোড়া ট্রেন চলেছে ১০ মিনিট পর পর। এতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের যাত্রা শেষ করেছে মেট্রোরেল।

আধুনিক এ বৈদ্যুতিক রেলে চড়ার সাধ নিল ঢাকাবাসী। অনেকেই আবার পরিবার-পরিজন নিয়েও ট্রেনে উঠেছেন প্রথম দিন। কিন্তু (টিকিটিং) ভেন্ডিং মেশিনের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অনেকে অপেক্ষা করেও টিকিট পাননি। ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে শেষ পর্যন্ত ট্রেনে চড়তে না পেরে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন।

সরেজমিন যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো প্রকার যানজটের ভোগান্তি ছাড়াই মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পৌঁছেছেন যাত্রীরা। সাবরিনা মমতাজ নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, যানজটের কষ্ট দূর হয়েছে। তিনি উত্তরায় থাকেন। অফিস করেন ফার্মগেট এলাকায়। তিনি বলেন, আমি জীবনে প্রথমবার মেট্রোরেলে চড়েছি। বিদেশেও কখনো চড়া হয়নি। অনেক ভালো লাগছে আমার। এখন থেকে নিয়মিতই যাতায়াত করব। ভোগান্তিও শেষ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমি সকালে একটু আগেভাগে স্টেশনে এসে লাইনে দাঁড়াই। তারপর গেট খুললে ভিতরে এসে নিজেই টিকিট কাটি। প্রথম ট্রিপের যাত্রী হতে পেরে বেশ খুশি খুশি লাগছে। অনেক আগেই চলে আসছি আগারগাঁও। ভাবতেই পারছি না বলেই হাসতে থাকেন এ ব্যাংক কর্মকর্তা।

বুধবার উদ্বোধনের পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় সাধারণ যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় মেট্রোরেল। যাত্রীদের নিয়ে মেট্রোরেল প্রথমবারের মতো সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে উত্তরার উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও স্টেশনের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভোর থেকেই দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সাধারণ যাত্রীদের। দ্রুত গতিতে ছুটে চলা ট্রেন। মাত্র কয়েক মিনিটেই পৌঁছে যায় আগারগাঁও স্টেশনে। সেখানকার দৃশ্যও ছিল একই রকম। সকাল থেকেই সাধারণ যাত্রীদের ভিড় ছিল এ স্টেশনে। মানুষ দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে ভ্রমণ করেছেন স্বচ্ছন্দ্যে।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানায়, গতকাল প্রথম দিনে ৩ হাজার ৭৫৬টি সিঙ্গেল জার্নি টিকিট বিক্রি হয়েছে। প্রতিটি টিকিটের দাম ৬০ টাকা। অর্থাৎ ৩ হাজার ৭৫৬ জন যাত্রী বহন করেছে মেট্রোরেল। একই দিনে ৯৯টি এমআরটি পাস বিক্রি হয়েছে। প্রতিটি পাসের ন্যূনতম মূল্য ৫০০ টাকা। সে হিসাবে কমপক্ষে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৮৬০ টাকা আয় করেছে ডিএমটিসিএল।

বহুল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হয়েছে বুধবার (২৮ ডিসেম্বর)। এদিন বেলা ১১টার পর উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের সি-১ ব্লকের খেলার মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নামফলক উন্মোচন করে মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন। ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোরেল নির্মাণকাজ চলছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার সহযোগিতায়।

শুরুতে সীমিত পরিসরে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলছে মেট্রোরেল। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে মেট্রোরেলে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ মেট্রোরেলে চড়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াত করা যাবে। আর আসছে মার্চ থেকে সব স্টেশনে ওঠানামা শুরু হবে।

সকাল ৯টার দিকে আগারগাঁও স্টেশনে গিয়ে দেখা যায় যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে মেট্রোরেল কর্মীদেরও। এ স্টেশনে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে লাইনে দাঁড়ায় সাধারণ মানুষ। দুপুর ১২টা নাগাদ এ লাইন গিয়ে ঠেকে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস পর্যন্ত। তবে নির্ধারিত সময়ে টিকিট কাটতে না পেরে এবং ট্রেনে চড়তে না পেরে আক্ষেপ নিয়ে ফিরে গেছেন হাজারো মানুষ। ট্রেন চলাচলের সময় দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত লাইনের দুই ধারের বাসিন্দারাও ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে নিজেদের আবাস স্থলের বারান্দা, গ্রিল, জানালা দিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে ট্রেন চলার দৃশ্য উপভোগ করেন। এ সময় যাত্রী ও দর্শনার্থীরা পরস্পরকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছাও জানান। ট্রেনে ওঠার আগে স্টেশনে টিকিটিং মেশিনের সামনে, টেনের ভিতরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীরা সেলফি ও ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ ট্রেনে উঠেই ভিডিও কলে অপরপ্রান্তে থাকা প্রিয়জনের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। গতকাল অনেকেই ঢাকার বাইরে থেকেও আসেন স্বপ্নের এই ট্রেনে চড়তে। খুলনা থেকে আসা মিজানুর রহমান জানান, স্বপ্নের এ ট্রেনে চড়ে প্রথমদিনের সাক্ষী হতে তিনি দুই দিন আগেই ঢাকা এসেছেন। উত্তরায় এক বন্ধুর বাসায় থেকে সকাল বেলা দিয়াবাড়ী স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে আগারগাঁও এসেছেন। আবার নতুন করে টিকিট কেটে আগারগাঁও থেকে উত্তরা গেছেন।

ধানমন্ডি লেক সার্কাস এলাকা থেকে বেসরকারি চাকরিজীবী জাবেদ আহমেদ বলেন, তিনি ৯টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। ১১টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন। সিঁড়িতেই উঠতে পারেননি। শুনেছেন ভিতরে টিকিটিং মেশিন কাজ করছেন না। ফলে ১২টার পর তিনি ফিরে গেছেন। যাওয়ার সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এটা কোনো কথা হলো, কোনো সিস্টেম ঠিক না করেই এভাবে তাড়াহুড়া করে চালু করল। অল্প কিছু মানুষ উঠল। হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে ফিরে গেল। আমাদের কি সময়ের মূল্য নেই।

ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ জানায়, যাত্রীদের অনেকেই না বুঝে টিকিটিং মেশিনে বড় নোট টাকার (৫০০/১০০০) ঢুকিয়েছে, কিন্তু ভাড়ার নির্ধারিত টাকা নেওয়ার পর ফেরত দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা মেশিনের ভিতরে নেই, এ কারণে মেশিন হ্যাং হয়ে অকার্যকর হয়ে গেছে। ফলে স্টেশনের মূল গেটের বাইরেও বহুদূর ছাড়িয়েছে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের লাইন। তবে সামনের দিনগুলোতে এমনটা যেন না হয় সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে টিকিট কাটার জন্য ছোট ছোট নোট ব্যবহারেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে টিকিটিং মেশিনে সমস্যা হওয়ার কারণে যাত্রীরা যথা সময়ে টিকিট হাতে পাননি। ফলে ট্রেনে উঠতে পারেননি। কিন্তু শিডিউল ঠিক রাখতে ট্রেন নির্দিষ্ট সময় পর পর স্টেশন ছেড়ে গেছে। এতে অনেক ট্রেনেই যাত্রীর সংখ্যা কম ছিল। অনেক সিটও ফাঁকা গেছে। অথচ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বহুসংখ্যক যাত্রী ট্রেনে উঠতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফিরে গেছেন।

মেট্রোরেল পাস নেবেন যেভাবে : মেট্রোরেলে চলাচলের জন্য আজ ৩০ ডিসেম্বর থেকে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর ও আগারগাঁও স্টেশনের কাউন্টার থেকে এমআরটি পাস সংগ্রহ করা যাবে। এমআরটি পাস সংগ্রহের জন্য যাত্রীদের কার্ডের মূল্য বাবদ ২০০ টাকা ও ব্যবহারযোগ্য ৩০০ টাকাসহ মোট ৫০০ (পাঁচ শত) টাকা কাউন্টারে পরিশোধ করতে হবে এবং পূরণকৃত এমআরটি পাস নিবন্ধন ফরম জমা দিতে হবে। এমআরটি পাস নিবন্ধন ফরমটি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (DMTCL)-এর ওয়েবসাইট এ (http://www.dmtcl.gov.bd) পাওয়া যাবে।

সর্বশেষ খবর