শনিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

তুচ্ছ ঘটনায় বাড়ছে খুনোখুনি

খুনের হটস্পট ওয়ারী ও মিরপুর

আলী আজম ও মাহবুব মমতাজী

তুচ্ছ ঘটনায় বাড়ছে খুনোখুনি

গত বছরের ১৬ জুলাই বগুড়ার গাবতলীতে স্থানীয় যুবসংঘের উদ্যোগে একটি ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। দুই দলে বিভক্ত খেলায় মোতালেব ওরফে খোকন আর নাহিদ নামে দুই যুবক একই দলে খেলছিলেন। তাদের দল ২-১ গোলে পিছিয়ে ছিল। খেলা শেষ হওয়ার প্রায় এক মিনিট আগে একটি ফাউলে তারা পেনাল্টি শট পান। এর আগে স্ট্রাইকার হিসেবে দলের একমাত্র গোলটি করেছিলেন নাহিদ। খেলায় সমতা আনার জন্য পেনাল্টি শটটিও নাহিদকে দিয়ে করাতে দলের অধিনায়কসহ সবাই একমত হন। কিন্তু খোকন সেই পেনাল্টি শট নেবেন বলে গোঁয়ার্তুমি করতে থাকেন। নাহিদ পেনাল্টি শটের প্রস্তুতি নিলে খোকন তাকে মাঠের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মারধর করতে থাকেন। তখন নাহিদের ফুফাতো ভাই মামুন এর প্রতিবাদ করেন।

মামুনের সঙ্গে সৃষ্ট এই বিরোধের জেরে তাকে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন খোকন। এরপর স্থানীয় পিন্টু মিয়ার দোকানে মামুনকে ধারালো দায়ের কোপে গুরুতর জখম করেন খোকন। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে নিয়ে চিকিৎসা করান। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১৭ জুলাই রাতে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। 

এ শুধু একটি ঘটনার বর্ণনা। সারা দেশে এমন ঘটনার সংখ্যা হাজারের বেশি। তবে ঢাকায় গত বছরে খুনোখুনির ঘটনা ছিল ১৭৭টি। ২০২১ সালের তুলনায় ১১টি খুনের ঘটনা বেশি ঘটেছে। সে বছর খুনের ঘটনা ছিল ১৬৬টি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মামলার তথ্যে যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা হলো- ঢাকার ওয়ারী ও মিরপুরে খুনের ঘটনা বেশি। গত বছর ১৭৭টি খুনের ঘটনার মধ্যে ৩৭টি হয়েছে ওয়ারীতে, আর ৩১টি মিরপুরে। ২০২১ সালেও ৩৫টি ছিল ওয়ারীতে এবং ২৬টি মিরপুরে। ডিএমপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ২১টি করে খুনের ঘটনা ঘটে গুলশান ও মতিঝিলে, ১৭টি করে উত্তরা ও লালবাগে, রমনায় ১৬টি এবং তেজগাঁও ১৩টি। ২০২২ এবং ২০২১ অপরাধের তথ্য বিশ্লেষণ করে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর যেসব এলাকায় নিম্ন আয় ও ভাসমান মানুষের বসবাস বেশি, সেখানে অপরাধের ঘটনাও বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, তুচ্ছ কারণে যেসব মারামারি হচ্ছে সেগুলোও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আমলে নেওয়া উচিত। এসব ঘটনায় যারা জড়িত তাদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। এসব কেন ঘটছে- সেগুলো নিয়েও গবেষণা করা দরকার। আর সম্পর্কে অবনতির কারণে একপক্ষ আরেক পক্ষের ওপর হামলা করছে। কোনো এলাকায় এটা বাড়ে, আবার কোনো কোনো এলাকায় কমে। আগের সংগঠিত কোনো অপরাধের বিচার যদি দ্রুত সময়ে না হয়, তাহলে এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়।

এদিকে পুলিশ সদর দফতরের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৪৫ হাজার ১৪৬টি। ২০২১ সালে সারা দেশে হত্যাকাে র ঘটনা ঘটে ৩ হাজার ৪৫৮টি। এর আগের বছর ২০২০ সালে খুনের ঘটনা ছিল ৩ হাজার ৫৩৯টি। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৫৩।

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) বিপ্লব বিজয় তালুকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেখানে খুনের ঘটনা ঘটে সেখানে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে যাই। একই সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এক ধরনের অস্থিরতা থেকেই তুচ্ছ ঘটনা থেকে এ খুনোখুনি বাড়ছে বলেও তিনি মনে করেন।

পুলিশের আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা দৈশে তিন কারণে খুনের ঘটনা বেশি। এর মধ্যে পারিবারিক কলহে খুনের সংখ্যা ২১ শতাংশের বেশি, সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিরোধে ১৩ শতাংশের বেশি এবং পূর্বশত্রুতায় খুনের সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি।

এই তিনটির একটির প্রমাণ পাওয়া যায় গত বছরের ২২ জুন সাতক্ষীরায়। ওই জেলার দেবহাটায় স্ত্রীর তালাকের নোটিশ পেয়ে শ্বশুরকে ঘুমন্ত অবস্থায় কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে সালাউদ্দিন সানা (২৮) নামে একজনের বিরুদ্ধে। তাকে ওই ঘটনার সপ্তাহখানে পর ঢাকার কেরাণীগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

এ বিষয়ে সিআইডি জানায়, সালাউদ্দিনের আপন খালু আজগর আলী এবং দ্বিতীয় শ্বশুর। তিন প্রথমে ২০১৫ সালে একটি বিয়ে করেন ও ২০১৮ সালে আপন খালাতো বোন শিল্পী পারভীনকে (২২) বিয়ে করেন। দিনমজুর সালাউদ্দিন বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে স্ত্রী পারভীনকে মারধর করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৮ জুন রাতে স্ত্রী পারভীনকে মারপিট করেন, খবর পেয়ে পারভীনের বাবা আজগর আলী মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বিস্তারিত জানতে চান। তখন সালাউদ্দিন যৌতুকের দাবি করলে আজগর ১ লাখ টাকা দিতে রাজি হন। কিন্তু তাৎক্ষণিক নগদ টাকা না দিলে পারভীনের সঙ্গে সংসার করবে না বলে হুমকি দেন। তখন সালাউদ্দিনের পরিবারের সদস্যদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মেয়ে পারভীনকে নিয়ে বাড়ি চলে যান আজগর আলী। আর সালাউদ্দিনের ঠিকানায় তালাকনামা পাঠিয়ে দেন শিল্পী। এর ফলে আজগর আলীর ওপর প্রতিশোধ নিতে পরিকল্পনা করতে থাকেন সালাউদ্দিন। সে অনুযায়ী ২১ জুন রাতে বাড়িতে ঢুকে ঘুমন্ত আজগরকে দা দিয়ে কুপিয়ে পালিয়ে যান সালাউদ্দিন ও তার দুই সহযোগী। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে ২২ জুন ভোরে আজগর মারা যান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর