৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েকটি ‘মব ফ্যাসিজম’ ঘটে। তবে এর আগেও দেশে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বহু দেখা গেছে। সম্প্রতি ছিনতাই ও ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে একের পর এক। এরই মধ্যে এ রকম ঘটনা আতঙ্ক ছড়িয়েছে সারা দেশে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মব ফ্যাসিজমের নামে মারামারি, হামলা, ভাঙচুর, অত্যাচার কিংবা হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে দর্শনার্থীকে আটকে মারধর করায় বিক্ষুব্ধরা হামলা ও ভাঙচুর করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা যায়, ৩১ মে রংপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বাসভবনে হামলা ও মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আগের দিন রাতে রাজধানীর মিরপুরে একটি বাড়িতে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নাসিমা জামান ববি এবং তাঁর স্বামী রংপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা সিরাজুল ইসলাম অবস্থান করছেন-এমন সন্দেহে বাড়িটির সামনে রাতভর বিক্ষোভ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। বিক্ষোভকারীদের দাবির মুখে পরদিন সকালে মিরপুর ১ নম্বরের চিড়িয়াখানা রোডের ওই বাড়ি থেকে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ইবনে আজিজ মো. নুরুল হুদা ফরহাদকে আটক করে পুলিশ। ১৯ মে মধ্যরাতে রাজধানীর ধানমন্ডিতে মব সৃষ্টি করে এক প্রকাশককে স্বৈরাচারের দোসর আখ্যা দিয়ে তাঁর বাসার সামনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে তিন সমন্বয়ককে আটক করে পুলিশ। পরদিন বিকালে জাতীয় নাগরিক কমিটির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের উপস্থিতিতে পরিবারের জিম্মায় মুচলেকা নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্যবিরোধী নামধারী কিছু টাউট, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এ মব ফ্যাসিজমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বৈষম্যবিরোধী নেতা পরিচয়ে অনেকেই পাড়ামহল্লায় মব সৃষ্টি করে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গ্যাং তৈরি করছেন বলে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মব জাস্টিসের নামে যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। কারও ব্যক্তিগত ক্ষোভ চরিতার্থ করার জন্য পিটিয়ে হত্যা কিংবা মব জাস্টিসের নামে হত্যার কোনো সুযোগ নেই। বরং অতীতের অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও প্রতিহিংসার চিত্রগুলোর যাতে কোনোভাবেই পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জায়গায় সোচ্চার থাকা জরুরি।’
এর আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে স্পিডবোট নিয়ে ডাকাতি করতে এসে স্থানীয়দের পিটুনিতে নিহত হন তিন ডাকাত সদস্য। ডাকাতরা গুলি ছুড়লে আট ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন। পরে ট্রলার নিয়ে ধাওয়া করে গণপিটুনি দিলে আহত হন সাত ডাকাত। তাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটে মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের বিদ্যাবাগীশ ও শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের তেঁতুলিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকার। পরে মাদারীপুরে কীর্তিনাশা নদী থেকে আরেক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে গণপিটুনির শিকার হন দুই যুবক। উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনের ফুটওভার ব্রিজে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয় তাদের। পুলিশ উদ্ধার করে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, একদল মানুষ ঝুলে থাকা দুই ব্যক্তিকে মারধর করছেন।
২০১৯ সালে ছেলেধরা সন্দেহে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় তসলিমা বেগম রেণু নামে এক নারীকে হত্যার ঘটনা মানুষ এখনো ভোলেনি। ২০১১ সালে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে ঢাকার অদূরে সাভারের আমিনবাজারে ওই ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একই বছরের ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়ায় ডাকাত সাজিয়ে কিশোর শামসুদ্দিন মিলনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও মানুষকে এখনো নাড়া দেয়। পুলিশ গাড়িতে করে এনে জনতার হাতে এ কিশোরকে ছেড়ে দেয়। সেখানে পুলিশের উপস্থিতিতেই মিলনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সারা দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ৪৯ জনের। তবে গত বছর গণপিটুনির ঘটনায় মোট নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগেই ৫৭ জন। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ১৯, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭, খুলনা বিভাগে ১৪, বরিশাল বিভাগে ৭, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫, রংপুর বিভাগে ৫ এবং সিলেট বিভাগে ৪ জন নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন।