২ আগস্ট, ২০২৪। গত বছর আজকের দিন ছিল স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে থাকা ছাত্র-জনতার ৩৩ জুলাই। দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ এবং রাজধানীতে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি ঘিরে ফুঁসে ওঠে সারা দেশ। কোথাও পুলিশের সঙ্গে, কোথাও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ ঘটে। এ দিন দুজন নিহত এবং ২ শতাধিক আহত হন।
পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে এ দিন খুলনা রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। মিছিলকারীদের পিটুনিতে সুমন কুমার ঘরামী নামে পুলিশের এক কনস্টেবল নিহত হন। হবিগঞ্জে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন পিডিবির অস্থায়ী কর্মচারী পথচারী মোস্তাক মিয়া। সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘৩৪ জুলাই দেশের প্রতিটি পাড়ামহল্লায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হবে। ৩৫ জুলাই থেকে সারা দেশে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন পালিত হবে। বর্তমান সরকারকে কোনো ট্যাক্স দেওয়া হবে না, সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে, কেউ অফিসে যাবে না। সচিবালয় বন্ধ থাকবে। বঙ্গভবন, গণভবনে কোনো গাড়ি ঢুকবে না। বিদ্যুৎ বিল ও গ্যাস বিল দেওয়া হবে না।’ মাসুদ বলেন, ‘সারা দেশের ছাত্র, নাগরিক, অভিভাবক, মা-বোন যে যে অবস্থায় আছেন ৩৪ জুলাই থেকে সবাই রাজপথে থাকবেন। কেউ ঘরে বসে থাকবেন না। কারণ প্রতিটি লাশের রক্তের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। প্রতিটি দল ও মতের মানুষের প্রতি উদাত্ত আহ্বান-জাতীয় ঐকমত্যে ঐক্যবদ্ধভাবে আপনারা রাস্তায় নেমে আসবেন। পুলিশ বাহিনীর প্রতি আহ্বান-আর গুলি ছুড়বেন না। আমরা আপনাদেরই সন্তান, ভাই, অনুজ। আমাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল, আছে, থাকবে। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে রাজপথে থাকবেন।’ শিক্ষার্থীদের ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে দেশের প্রথিতযশা শিল্পীরা ৩৪ জুলাই ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে মিলিত হয়ে গানে গানে সংহতি প্রকাশের ঘোষণা দেন। ৩৩ জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানাতে বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেন চিকিৎসক, নার্স ও মেডিকেল শিক্ষার্থীরা। শহীদ মিনারে আয়োজিত বিশাল জমায়েতে নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দেন। ছিলেন কবি ও লেখকসমাজও।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে সাংস্কৃতিক সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। বৃষ্টিতে ভিজে গান, কবিতা আর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এ সমাবেশের আয়োজন করে সংগঠনটি। কোটা আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সংঘাতে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। প্রাণহানির ঘটনার প্রতীক হিসেবে সমাবেশের সামনে রাখা ছিল কফিন। শহীদ মিনারে বক্তব্য দেওয়ার সময় চিকিৎসকরা বলেন, দেশে যে বৈষম্য ও অরাজকতা চলছে এটি রুখতে ছাত্রসমাজ মাঠে নেমেছে। দেশের সব চিকিৎসক শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে পাশে আছে এবং সর্বক্ষণ তাদের পাশে থাকবে। সমাবেশ শেষে শহীদ মিনার থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত মিছিল করেন চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত হয় দ্রোহযাত্রা। এতে অংশ নেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, রোবায়েত ফেরদৌস, সি আর আবরার, উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা, চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমেদ সায়মন, সংগীতশিল্পী কৃষ্ণকলি মজুমদার এবং বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সংস্কৃতিকর্মী।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আমরা ৫২-এর পর থেকে অনেক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, কিন্তু এই জুলাইয়ে মাত্র কয়েক দিনে যে রকম হত্যাযজ্ঞ হয়েছে এ রকম হত্যাযজ্ঞ আর কোনো সরকার করেনি, এত রক্তপাত কেউ করেনি। সরকার ভেবেছিল এ রকম নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালালে আন্দোলন দমে যাবে। কিন্তু প্রতিবাদ আরও বেড়েছে। তিন বছরের বাচ্চা থেকে শ্রমজীবী পেশাজীবী সবার ওপর আক্রমণ আসছে। জমিন থেকে আক্রমণ আসছে, আকাশ থেকেও আক্রমণ আসছে। গুলিতে ৩ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। যারা নিহত হয়েছে তাদের মা-বাবারা হাহাকার করছেন।’ সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে দ্রোহযাত্রা নামে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এ মিছিলে অংশ নেন অভিভাবকরাও।