৪ এপ্রিল, ২০২০ ১৯:৫২

ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মহামারীতে মারা যায় ৫ কোটিরও বেশি মানুষ

অনলাইন ডেস্ক

ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মহামারীতে মারা যায় ৫ কোটিরও বেশি মানুষ

১৯১৮ সালের শেষের দিকে ভয়ঙ্কর এক মহামারী সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ওই মহামারীর নাম ছিল স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষের। এই সংখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যার চাইতেও বেশি। সেসময় সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশেরই মৃত্যু হয়েছিল এই ভাইরাসে। খবর বিবিসি বাংলার।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন প্রায় শেষ হয়ে আসার পথে। যুদ্ধ শেষে সৈন্যরা ফিরে যাচ্ছে যার যার দেশে। কিন্তু তারা কল্পনাও করতে পারেনি যে বাড়িতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল নতুন এক শত্রু। বিবিসির একজন ব্রডকাস্টার অ্যালেস্টার কুক, যিনি 'লেটার ফ্রম আমেরিকা' অনুষ্ঠানের জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনিও শৈশবে এই স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি সেই অভিজ্ঞতার কথা ২০০৪ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছিলেন এভাবে:

"আমি বিছানায় গেলাম এবং হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। জীবনে নিজেকে কখনো এতোটা অসুস্থ মনে হয়নি। শরীরে প্রচণ্ড রকমের ব্যথা হচ্ছিল। ক্লান্তি আর অবসাদে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। গায়ে ছিল প্রচণ্ড জ্বর।" এইডা ডারউইন নামের একজন নারী বর্ণনা করছিলে যে তার পিতাও কীভাবে এই ফ্লুতে আক্রান্ত হন। রণাঙ্গনে একটি সামরিক হাসপাতালে সৈন্যদের নার্সিং সেবা দিচ্ছিলেন তার পিতা এবং সেখানেই তিনি আক্রান্ত হন।

তিনি বলেন, "সেদিন সোমবার সকাল সকাল। আমার বাবা অসুস্থ। তিনি তো পুরো যুদ্ধের সময় বেঁচে ছিলেন। কতো বিপদ ছিল তার। কিন্তু বাড়িতে ফিরে আসার সাথে সাথেই তিনি ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে গেলেন।" কিন্তু কথা হচ্ছে এর নাম স্প্যানিশ ফ্লু কেন হলো? এর সঙ্গে কি স্পেনের কোন সম্পর্ক আছে? লন্ডন কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়েলকাম ট্রাস্টের একজন গবেষক মার্ক হনিগসবাউম ১৯১৮ সালের এই মহামারি নিয়ে একটি বই লিখেছেন। নাম 'লিভিং উইথ এঞ্জা।'

তিনি বলেন, স্প্যানিশ ফ্লু নামকরণের পেছনে কারণ হলো স্পেনের সংবাদ মাধ্যম এই ফ্লুর খবরটি মুক্তভাবে পরিবেশন করছিল। "যখন এই মহামারি শুরু হয় তখন স্পেনের রাজ পরিবার এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অসুস্থতা হওয়ার খবর স্পেনে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এই ভাইরাসের কারণে লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। তার মধ্যে ছিল ব্রিটেনও। কিন্তু ব্রিটেন যেহেতু জার্মানির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল তাই অনেক খবর তখন প্রকাশ করা হচ্ছিল না। ফলে সেখানে অসুস্থতার খবর খুব একটা প্রচারিত হয়নি।"

স্প্যানিশ ফ্লুর প্রথম ধাক্কাটি আসে মে-জুন মাসে। কিন্তু এটি স্পেন থেকে আসেনি, এসেছিল আমেরিকা থেকে। মার্ক হনিগসবাউম বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জার খবর প্রথম এসেছিল আমেরিকায় সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প থেকে। ওই ক্যাম্পটি ছিল কেন্টাকিতে। "আক্রান্ত সৈন্যরা ছিল তরুণ। তারা সাধারণত ফার্মে কাজ করতো। প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্যে তারা কেন্টাকির একটি ক্যাম্প ফুনস্টনে যেত। একটি জাহাজে করে তারা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সের বোর্দোতে চলে আসে যুদ্ধ করতে। জাহাজ থেকে নামার পরপরই ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলে আরো যেসব মার্কিন সৈন্য ছিল তাদের মধ্যেও এই অসুস্থতা ছড়িয়ে পড়ে।"

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুটেসসে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্পে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন রয় গ্রিস্ট। সেসময়কার পরিস্থিতির কথা তিনি তার এক বন্ধুকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, "প্রায় চার সপ্তাহ আগে এই মহামারি শুরু হয়েছে। খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ক্যাম্পে সবার মনোবল ভেঙে গেছে। সাধারণ সব কাজ কর্মও বন্ধ হয়ে গেছে।"

"ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত হওয়ার পর যখন কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে যে তার ভয়াবহ ধরনের নিউমোনিয়া হয়েছে। এরকম আগে কখনো হয়নি। ভর্তি হওয়ার দু'ঘণ্টা পর চোখের নিচে বাদামী দাগ পড়ে যায়। আরো কয়েক ঘণ্টা পরে সেটা কান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তারপর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তখন কে শ্বেতাঙ্গ আর কে শ্বেতাঙ্গ নয় সেটা বোঝা যায় না। মৃত্যু আসার আগে মাত্র কয়েক ঘণ্টা পাওয়া যায়। এক পর্যায়ে ভয়াবহ রকমের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।"

মার্ক হনিগসবাউম বলছিলে কীভাবে এই ভাইরাসটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো: "সেসময় যুদ্ধের কারণে মানুষ প্রচুর চলাচল করতো। সৈন্য ও শ্রমিকরা যখন তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে গেল, তখন এই ফ্লু উত্তর ফ্রান্সের রণাঙ্গন থেকে তাদের নিজেদের দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়লো।" বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লুর অন্যান্য প্রজাতি থেকে এই বিশেষ ফ্লুটি ছিল ভয়ঙ্কর রকমের। মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জায় সাধারণত বয়স্ক লোকজন ও শিশুরা আক্রান্ত হয়। কিন্তু এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল তরুণ বয়সীরাও।

স্প্যানিশ ফ্লুর দ্বিতীয় এবং আরো বেশি প্রাণঘাতী ধাক্কাটি আসে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে। সেসময় কেপউটাইন হাসপাতালের প্রধান নার্স লন্ডন টাইমসের কাছে লেখা এক চিঠিতে তখনকার পরিস্থিতি তুলে ধরেছিলেন এভাবে: "দু'সপ্তাহে ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হলো। কেপটাউনকে মনে হচ্ছিল মৃতের নগরী। রাস্তা থেকে মৃতদেহ তুলে নেওয়ার জন্যে কাভার্ড ভ্যান সারা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দোকানপাট বন্ধ। ট্রেন ও ট্রাম চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। থিয়েটার ও গির্জাগুলোও সব খালি। পরিস্থিতি ছিল লন্ডনের দ্যা গ্রেট প্লেগের মতো।"

"মৃতদেহ দাফন করার জন্য কোন যাজক কিম্বা গির্জার কোন ব্যক্তিকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেপটাউন থেকে ছয় মাইল দূরে যে বিশাল গোরস্থান সেখানে কবর খোঁড়ার জন্যেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। লোকজন তাদের বন্ধু বান্ধব কিম্বা আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে আসছিল। কিন্তু তারাও এতো দুর্বল যে দুই কী তিন ফুটের বেশি খুঁড়তে পারছিল না।" মার্ক হনিগবাউম বলছেন, এতো মানুষের মৃত্যু হওয়ার পরেও স্প্যানিশ ফ্লু ইতিহাসে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি।

এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, "প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল প্রত্যেকটি দেশের জাতীয় পরিচয় তুলে ধরার যুদ্ধ। সৈনিকদের ভূমিকা ছিল বীরের মতো। এই যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছে তাদের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জায় যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের তো কোন তালিকা নেই। কারণ এসব লোকের মৃত্যুকে নায়কোচিত মৃত্যু হিসেবে দেখা হয়নি। পরিবারগুলো খুবই ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে।" এই স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা খুব দ্রুত এবং হঠাৎ করেই যেমন এসেছিল, ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে, তার পর পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে ১৯২০ সালের শেষের দিকে হঠাৎ করেই এটি উধাও হয়ে গিয়েছিল।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর