মালয়েশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ। ১৩টি রাজ্য এবং তিনটি ঐক্যবদ্ধ প্রদেশ নিয়ে গঠিত দেশটি। এর রাজধানী শহর কুয়ালালামপুর এবং পুত্রজায়া হল ফেডারেল সরকারের রাজধানী। দক্ষিণ চীন সাগর দ্বারা দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত, মালয়েশিয়া উপদ্বীপ এবং পূর্ব মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার স্থল সীমান্তে রয়েছে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, এবং ব্রুনাই; এর সমুদ্র সীমান্ত রয়েছে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও ফিলিপানের সাথে। দেশটির মোট জনসংখ্যা ৩২.৩৭ মিলিয়ন।
মালয়েশিয়া একটি উঠতি শিল্পউন্নত বাজার অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিবেচিত। সরকার বিভিন্ন ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশটির অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি খুব অল্প সময়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশের তালিকায় উঠে আসে।
কিন্তু ২০১৮ সালে দেশটিতে দীর্ঘ ষাট বছর ক্ষমতায় থাকা বারিসান নাসিওনাল জোটকে নির্বাচনে হটিয়ে সরকার গঠন করে মাহাথির মোহাম্মদ নেতৃত্বাধীন ‘পাকাতান হারাপান’। এই ঘটনাকে বলা হচ্ছিল অভূতপূর্ব এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। কিন্তু দুই বছরের মধ্যেই নতুন সেই জোট সরকারের পতন হল এবং পুরনো দলটি আবার ক্ষমতাসীন হয়। জয়ের মাধ্যমে যে জোট এতটা আশার সঞ্চার করেছিল এত দ্রুত কেন তাদের পতন হল?
বলা হচ্ছে, মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে বড় প্রভাবক আবাসন খাতে চীনা বিনিয়োগ। ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডি.সি.ভিত্তিক একটি নির্দলীয় আন্তর্জাতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমনটিই দাবি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকট মালয়েশিয়ার প্রবৃদ্ধির মডেল নিয়ে দেশটির নীতিনির্ধারকদের ভাবাতে শুরু করে। সিঙ্গাপুর, জাপান ও চীনসহ এশিয়ার আর্থিক পাওয়ার হাউজগুলো থেকে বিনিয়োগ আকর্ষণ করে নিয়ে আসতে উদ্যোগী হন দেশটির নীতিনির্ধারকরা। চলতি শতকের শুরুর দশকের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার প্রয়াস নিতে থাকেন তারা। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে অনেকটা ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় নির্মাণ করা হয় এসব অর্থনৈতিক করিডোর। প্রথম অর্থনৈতিক করিডোরটি চালু হয় ২০০৬ সালে জোহর প্রদেশে। ২০১০ সালের মধ্যেই এমন আরও চারটি অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তোলা হয়। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় শিল্প ও সেবা—উভয় খাতেই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ নিয়ে আসতে থাকে সরকারি উৎসাহ, প্রণোদনা ও নীতিসহায়তা।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এসব অর্থনৈতিক করিডোর নিয়ে মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ের রাজনীতিতে ব্যাপক শোরগোল তৈরি হয়। নিজ নিজ অগ্রাধিকার, রাজনীতি ও প্রয়োজন বিবেচনায় একের পর এক প্রকল্প হাতে নিতে থাকেন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। বিশেষ করে আবাসন ও নির্মাণ খাতে এ প্রতিযোগিতা বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। পছন্দসই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর কর্তাব্যক্তিদের মূল হাতিয়ার হয়ে ওঠে চীনা বিনিয়োগ। অল্প সময়ের মধ্যেই দেশটির আবাসন খাতের বড় প্রভাবক হয়ে ওঠে চীনা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
এসব প্রকল্প এখন বিরোধী পক্ষগুলোরও রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আবার ক্ষমতার পালাবদলে বিরোধী দলগুলো সরকারে গিয়ে প্রকল্পগুলো নিয়ে বিরোধিতার পথ ত্যাগ করারও নজির রয়েছে অনেক। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে মালয়েশিয়ার স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতির বড় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে দেশটির আবাসন খাতে চীনা বিনিয়োগ।
মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক করিডোরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো হলো ইস্কান্দার মালয়েশিয়া। জাপানের ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক গুয়ানি লিম এবং ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি কুয়ালালামপুরের বিশেষজ্ঞ কেন খুন এনজি সম্প্রতি করিডোরটিতে চীনা আবাসন খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের গতিপ্রকৃতি নিয়ে এক পলিসি পেপার তৈরি করেছেন।
‘হাউ মালয়েশিয়ান পলিটিকস শেপড চাইনিজ রিয়েল এস্টেট ডিলস অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট’ শিরোনামে পলিসি পেপারটি গত মাসের শেষ দিকে প্রকাশ করেছে কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস।
গুয়ানি লিম ও কেন খুন এনজির পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, জোহর প্রদেশে নির্মিত করিডোরটিতে চীনা বহুজাতিকগুলোর বিনিয়োগকে বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই গ্রহণ করেছিলেন প্রাদেশিক সরকারের কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ ছিল, ইস্কান্দার মালয়েশিয়ায় নিজ নিজ প্রয়োজন ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন। আবার এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে রেষারেষিও ছিল। যদিও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত একটি রাজনৈতিক দলের হাতেই। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি জোহর প্রদেশের স্থানীয় পর্যায়ে আর থেমে থাকেনি। গোটা মালয়েশিয়ায়ই এর বড় ধরনের প্রভাব দেখা গিয়েছে।
বিশেষ করে ইস্কান্দার মালয়েশিয়ায় চীনের গুয়াংডংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কান্ট্রি গার্ডেনের বাস্তবায়নকৃত ‘ফরেস্ট সিটি’ শীর্ষক বিলাস ও ব্যয়বহুল প্রকল্প মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড় ধরনের ওলটপালট ঘটিয়ে দিয়েছিল। প্রকল্পটিকে ঘিরে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা। প্রকল্পটি নিয়ে ওই সময় মালয়েশিয়াজুড়ে নানা গুজব ও আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০১৮ সালে নাজিব রাজাক সরকারকে উত্খাতে মালয়েশিয়ায় ব্যাপক আন্দোলন দানা বেঁধে যায়। ওই সময় মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপানের যাবতীয় প্রচার-প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল প্রকল্পটি।
এ প্রকল্প নিয়ে নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মালয়েশিয়ার ভোটাররা নাজিব রাজাকের ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন শাসন করা দল ইউএমএনওর ব্যাপক ভরাডুবি ঘটে। বেশ কয়েকটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ হারায় ইউএমএনও। যদিও জোহরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম হয় ইউএমএনও নেতৃত্বাধীন বারিসান নাসিওনাল জোট।
নাজিব রাজাক সম্প্রতি অভিযোগ তুলেছেন, ফরেস্ট সিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টটিকে তার সরকারবিরোধী নেতিবাচক প্রচারণার হাতিয়ার বানিয়েছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। ওই সময় মাহাথিরের পাকাতান হারাপানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, প্রকল্পটির মাধ্যমে মালয়েশিয়ার নিজস্ব সম্পদ চীনাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সাত লাখ চীনা নাগরিককে মালয়েশিয়ায় নিয়ে এসে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নাজিব রাজাকের সরকারকে কেন্দ্র থেকে উত্খাতের পেছনে মাহাথির মোহাম্মদ ও তার দলের এসব অভিযোগের বড় ভূমিকা রয়েছে।
নাজিব রাজাকের অভিযোগ, মাহাথির নিজে ভোটারদের কথা দিয়েছিলেন ক্ষমতায় এলে প্রকল্পটি বাতিল করবেন তিনি। যদিও ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি নিয়ে তার অবস্থান রাতারাতি বদলে যায়।
মালয়েশীয় রাজনীতির বহুমুখী প্রভাবকগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে দেশটির আবাসন খাতের চীনা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। দেশটির রাজনীতির অনুষঙ্গ হয়ে উঠলেও এখনো দেশটির পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিবেশে কোম্পানিগুলো খুব একটা প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেনি।
এ বিষয়ে পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য হল, মালয়েশিয়ায় এখন চীনা যে বিনিয়োগ আছে, তা স্থানীয় বিভিন্ন পক্ষের প্রয়াসের ফসল হিসেবেই এসেছে। যদিও স্থানীয় বিভিন্ন পক্ষই এসব বিনিয়োগকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। চীনের আগ্রাসী বিনিয়োগ বলতে যা বোঝানো হয়, সেটি এখানে অনুপস্থিত। স্থানীয় রাজনীতিই এসব বিনিয়োগের জন্য সামনের দিনগুলোয় বড় ফাঁদ হয়ে দেখা দিতে পারে। এছাড়া চীনের অভ্যন্তরীণ নানা প্রভাবকও কোম্পানিগুলোর জন্য অনভিপ্রেত কিছু পরিস্থিতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। ২০১৭ সালে তহবিল স্থানান্তর ও রেনমিনবির (ইউয়ান) অবমূল্যায়ন থামাতে মূলধন প্রবাহে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছিল বেইজিং। সে সময় চীন থেকে বিদেশে বিনিয়োগ নিয়ে যাওয়া উদ্যোক্তারা বড় ধরনের বিপাকে পড়ে গিয়েছিলেন। সূত্র: কার্নেগি এনডাউমেন্ট
বিডি প্রতিদিন/কালাম