সোনা বা স্বর্ণ এমন একটি ধাতু যা তার স্থায়িত্বের কারণেই মানুষের কাছে মূল্যবান। সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সোনা দিয়ে অলংকার বা গয়না বানিয়ে পরিধান করছে। গহনা শিল্প ফ্যাশন জগতের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে নারীর সাজ সম্পূর্ণ করতে গহনার ব্যবহার অপরিহার্য। গহনা শিল্পের রয়েছে বহু পুরনো ইতিহাস । প্রাচীন যুগে শুধু নারী নয়, পুরুষও গহনা পরত। বিশেষ করে রাজরাজড়াদের যেসব পুরনো ছবি আমরা দেখি, তাতে তাদের সোনার তৈরি নানা রকম ভারী গয়না পরে থাকতে দেখা যায়। এ স্বর্ণের অলংকার ছিল তাদের ক্ষমতা ও ঐতিহ্যের প্রতীক।
সারা পৃথিবীতেই সোনার গয়নার মূল্য ছিল ও আছে। চীন, ভারত, স্পেন, মিসরসহ প্রাচীন অনেক জনপদে মন্দিরে, রাজপ্রাসাদে বিপুল পরিমাণে স্বর্ণ মজুদ রাখার কথা শোনা যায়। তবে সোনার গয়নার ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইতিহাসের ক্ষমতাধর দুই নারীর কথা আমরা বলতে পারি। প্রাচীন মিসরে রানি ক্লিওপেট্রা এবং ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ। তাঁরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, আমরা পুরনো যে ছবি দেখি সেখানেও দেখা যায়, তাঁরা মণিমুক্তা ও স্বর্ণের ভারী অলংকার পরে আছেন। স্বর্ণালংকার একদিকে তাঁদের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে, অন্যদিকে শৌর্যবীর্যের প্রকাশ ঘটিয়েছে। বংশপরম্পরায় সেই গহনা হস্তান্তরিত হয়েছে। আমরা দেখতে পাই, একসময় প্রজন্মের পর প্রজন্ম হস্তান্তরিত হতে হতে অলংকারগুলো ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
মানুষ তার অঙ্গসজ্জার যেসব উপায় আবিষ্কার করেছে তার মধ্যে সারা পৃথিবীতে অলংকার পরিধানের রীতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে নিঃসন্দেহে সোনার অলংকার সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন নারীরা। সোনার গয়নার একটা আলাদা দ্যুতি ও চমক আছে এবং এটা মানুষের ব্যক্তিত্বে আত্মবিশ্বাস যোগ করতে পারে। অনেক সময় এটি নারীর গ্ল্যামারেরও অংশ।
আমাদের দেশে বিয়ের আসরে কনেকে সোনার গয়নায় সাজানোর রেওয়াজ আছে। লাল কাতান বা বেনারসির সঙ্গে সোনার গয়নার সোনালি রূপ নববধূকে অপরূপা করে তোলে। সোনা একটি সম্পদও বটে। আগেকার যুগে মা-চাচিরা সোনার গয়নাকে বিপদাপদে সহায় বলে প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতেন। সংসারে বড় ধরনের প্রয়োজন দেখা দিলে স্বর্ণ বিক্রি করে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার নজির আছে।
নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবে সোনা বা সোনার অলংকার সব সময়ই জনপ্রিয়। সাধারণ মানুষ মনে করে, স্বর্ণে বিনিয়োগ করলে লোকসানের ঝুঁকি নেই। কারণ স্বর্ণ নষ্ট হয় না। তা ছাড়া স্বর্ণের দাম বাড়লে-কমলেও তাতে আকাশপাতাল তফাত হয় না। উপমহাদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বহুকাল আগে থেকেই সোনার গয়না নারীদের বিশেষ প্রিয়। কিন্তু সেটা কি শুধু এজন্য যে, সোনা অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু; নাকি এর অন্য কোনো কারণও আছে?
আমরা দেখেছি, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বর্ণ এমন একটি ধাতু যা বিভিন্ন সময় রোগপ্রতিরোধ এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হতো। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সোনাকে বিশেষ উপকারী বলে মনে করা হয়। সোনা শরীরের ওপর উষ্ণ ও উদ্দীপনাময় প্রভাব রাখতে পারে। শরীরের নানা অংশের মধ্যে হাড়ের পক্ষে স্বর্ণকে বিশেষ উপকারী মনে করা হতো। স্বর্ণালংকার পরিধান করলে শরীর নীরোগ থাকে এবং হাড়ের দুর্বলতা দূর করতে স্বর্ণ উপকার করে বলে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সেজন্যই প্রাচীনকাল থেকেই শরীরে স্বর্ণ পরাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে হয়তো একটু সংশয় আছে।
কিন্তু ইতিহাসবিদরা বলেন, প্রাচীনকালে স্বর্ণ পরিধানের পেছনে এ কারণটিও কাজ করতে পারে। এখনো অনেকে বাড়িঘর পরিশুদ্ধ করতে সোনা-রুপা ধোয়া পানি ছিটিয়ে থাকেন। তা ছাড়া ত্বকের উজ্জ্বলতা ও লাবণ্য ধরে রাখতে সৌন্দর্যচর্চায় খাঁটি সোনার গুঁড়ো দিয়ে গোল্ড ফেসিয়ালের প্রচলন কিন্তু ইদানীং বেশ জনপ্রিয়।
আমরা জানি, প্রায় ৩ হাজার বছর আগে হিন্দু ও বৌদ্ধ আমলে সোনা ও রুপা দিয়ে গয়না তৈরি শুরু হয়। সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন মন্দিরে যে মূর্তি ও ভাস্কর্য দেখা যায় তাতে বিভিন্ন ধরনের অলংকার সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এসব অলংকারের মধ্যে মাথার টিকলি, গলার সাতনরি হার, কোমরের চন্দ্রহার, হাতের বাজুবন্ধ, চুড়ি, বালা, রতনচুর, বিভিন্ন নকশার আংটি, পায়ের নূপুর, চন্দ্রচক্র কানবালা, বিছাহার, শীতাহার, কানঝুমকা, অলংকৃত চিরুনি, চুলের কাঁটা, মাদুলি, মুকুট এসব বেশি দেখা যায়।
পরবর্তী সময় মুঘলরা যখন ভারতে আসে তখন অলংকার শিল্পের আবার পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায় এবং পারস্য থেকে শৈল্পিক সুষমাম-িত অলংকারের প্রচলন ঘটে। তখন সোনার অলংকারের সঙ্গে বিভিন্ন দামি রতেœর ব্যবহারও শুরু হয়। আমরা এখন দেখি গহনার সঙ্গে এ দামি রতেœর ব্যবহারটি প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অষ্টাদশ শতকের পর থেকে এখন পর্যন্ত সময়কে গহনার আধুনিক যুগ বলা চলে। এ সময় উপমহাদেশে ইংরেজের আগমন ঘটে এবং আমাদের প্রাচীনকালের গহনার রীতিনীতি, নকশার সঙ্গে পাশ্চাত্য ঘরানার নান্দনিকতার বিশেষ সমন্বয় ঘটে। তারই ফল আজকের এ গহনা।
বাংলাদেশে সব সময় সোনার গহনার চাহিদা ও জনপ্রিয়তা ছিল। পাশাপাশি গহনার নকশারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজের সৌন্দর্য বিকশিত করতে এবং ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটাতে গহনা ব্যবহার করে আসছে। এ ক্ষেত্রে যদি নারীর কথা আসে তাহলে বলতেই হবে যে, নারী আর গহনা এক সুতোয় গাঁথা। যে কোনো দেশ বা সংস্কৃতিরই হোক না কেন, গহনা পছন্দ করে না এমন নারী খুঁজে পাওয়া বিরল। কারণ এটা অনস্বীকার্য যে, নারীর সৌন্দর্যে গহনা সব সময় একটা অনন্য মাত্রা তৈরি করে। তা ছাড়া গহনাকে নারীর বিপদের সঙ্গী ও তার হাতের পাঁচ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। বাজারে সব সময়ই সোনার চাহিদা থাকে। ফলে যে কোনো সময় যে কোনো দরকারে সোনা বিক্রি করে নগদ অর্থ পাওয়া সম্ভব।
১৯৭১ সালে স্বর্ণের ভরি ছিল ১৬০ টাকা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ছিল ৫০০ টাকা। তারপর কালের বিবর্তনে সোনার দাম বেড়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারের দাম অনুযায়ী সোনার দাম ওঠানামা করে। স্বর্ণকে বলা হয় বিনিয়োগের সেফ হ্যাভেন। ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের জন্য সব সময়ই মানুষের পছন্দের তালিকায় রয়েছে স্বর্ণ। সব যুগে সব কালে এ উজ্জ্বল সোনালি ধাতুটির প্রতি মানুষের আকর্ষণ ছিল, আছে এবং থাকবে।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        