খ্রিস্টপূর্ব ৫২০০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে শাম (সিরিয়া ও সংলগ্ন অঞ্চল) ফিলিস্তিন, ইরাক, ইবার, ফিনিশিয়া ও মিসরে যেসব জাতিগোষ্ঠী বসবাস করত, তাদের চরিত্র, ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক রীতিনীতিতে এমন এক বিস্ময়কর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়, যা কেবল কোনো সাধারণ যোগাযোগের ফসল নয়, বরং এক অভিন্ন উৎসর ইঙ্গিত বহন করে। ইতিহাসবিদরা এই আশ্চর্যজনক মিলের ভিত্তিতে এমন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ব্যাবিলীয়, আসিরীয়, ক্যালডীয়, আমোরীয়, হিব্রীয়, আরবি ও মিসরীয়— এসব জাতিই মূলত একক বংশধারা অর্থাৎ সামি বা সেমেটিক জাতির অংশ।
তবে এই সামি জাতির আদি নিবাস কোথায় ছিল, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান। একদল গবেষক মনে করেন, এই জাতিগোষ্ঠীর বিস্তার উত্তর আফ্রিকা থেকে হয়েছে।
অন্যদিকে, বাইবেলের প্রভাবাধীন আরেকটি গোষ্ঠী মনে করে তাদের জন্মভূমি ছিল দজলা ও ফুরাত নদীর উপত্যকায়। কিন্তু যদি এই দাবিগুলোকে মেনে নেওয়া হয়, তবে ধরে নিতে হয় যে মানব সভ্যতা কৃষিনির্ভর জীবন গ্রহণের পর আবার বেদুইনি, যাযাবর জীবনে ফিরে গিয়েছিল, যা প্রকৃতপক্ষে বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী।
অবশেষে ইতিহাসবিদরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে সামি সভ্যতার মূল আঁতুড়ঘর ছিল এই আরব ভূমি। এই মরুপ্রান্তরেই লালিত-পালিত হয়েছে সেসব প্রতিভাবান মানুষ, যাঁরা পরবর্তীকালে নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করে সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছেন।
তাঁরাই পরিচিত হয়েছেন ফিনিশীয়, শামি ও ব্যাবিলীয় নামে। তাঁদেরই উত্তরাধিকার বহন করেছে ইহুদিরা, এদের মধ্য থেকেই উদ্ভূত হয়েছে খ্রিস্টধর্ম এবং এই বালুকাবেলা থেকেই উদিত হয়েছে এক দীপ্তিময় ধর্ম ইসলাম।
(Phillips K. Hitti : History of Arabs, P.3)
সামি ভাষার উৎপত্তি ও বিস্তারের নেপথ্যে
যখন সামি বা সেমেটিক জাতিগোষ্ঠী আরবের প্রান্তর থেকে যাত্রা করেছিল, তখন তারা সেই ভাষাকেই সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিল, যা সে সময় আরব ভূমিতে প্রচলিত ছিল। কালের পরিক্রমায়, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও সাংস্কৃতিক সংস্পর্শের কারণে এই ভাষার রূপান্তর ঘটে এবং তা একসময় ‘আরামি’ নামে পরিচিত হয়।
এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে শাম, আরব ও ইরাক—এই তিন অঞ্চলেই একসময় আরামি ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল।
এই আরামি ভাষা থেকেই বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন ভাষার জন্ম হয়—শামের আরামি থেকে হিব্রু (ইবরানি), ব্যাবিলের আরামি থেকে ক্যালডীয় এবং আরবের আরামি থেকে আরবি ভাষা গঠিত হয়। যখন আরবের ইয়েমেনি গোত্রগুলো হাবশা (বর্তমান ইথিওপিয়া) অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল, তখন তাদের ভাষা ও স্থানীয় ভাষার মিলনে আরবি ভাষার একটি পরিণত রূপ তৈরি হয়। সেই সঙ্গে হাবশি ভাষাও বিকশিত হয় এমনভাবে যে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা হাবশি ভাষাকে আরবিরই একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করেন। (আরদুল কোরআন, সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী, পৃষ্ঠা ১৩৭-১৪০)
ভাষার উৎস ও শব্দের মালিকানা : এক অনুসন্ধান
মূল বক্তব্যটি এই, শব্দের আগেই এগুলোর ধারণা, অর্থ এবং প্রয়োগগত প্রয়োজন সমাজে উদ্ভূত হয়েছিল।
আর যেহেতু সে সময় এই ধারণাগুলো প্রকাশের জন্য বিকল্প শব্দ মেলে না, তাই প্রয়োজনের তাগিদে সেই আদিম শব্দগুলোকেই টিকে থাকতে হয়েছে। কিন্তু যদি আমরা আরবি ও হিব্রু (ইব্রানি) ভাষার অভিধানগুলোর তুলনামূলক পর্যালোচনা করি, তাহলে স্পষ্ট দেখা যায়, প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহার্য এবং মৌলিক চাহিদা সম্পর্কিত শত শত নয়, বরং হাজার হাজার শব্দ এই দুই ভাষায় অভিন্ন বা অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন—
আবুন (বাবা), আরদ (জমিন), আসির (বন্দি), আমর (বিষয়, কাজ), উম্মুন (মা), বারদুন (ঠাণ্ডা), বারকুন (বিদ্যুৎ, আভা), বারকাতুন (বরকত), বাতনুন (পেট), বুকাউন (কান্না), বাকারুন (গরু), বিন (ছেলে), বিনতুন (মেয়ে), বাহিমাতুন (চতুষ্পদ প্রাণী), বিরুন (কূপ), বাইতুন (বাড়ি), বায়জাতুন (ডিম), তিলমিজুন (ছাত্র), জাবালুন (পাহাড়), জামালুন (উট), কিতাবুন (বই), লাহমুন (গোশত), মাউন (পানি), মিলহুন (লবণ), মাওতুন (মৃত্যু), লাবানুন (দুধ) ইত্যাদি।
প্রশ্ন হলো, এই আলোচিত শব্দগুলো কি আরবিতে কোরআন আবির্ভাবের আগেই প্রচলিত ছিল?
এর জবাব আমরা পেয়ে যাই খ্যাতনামা পাশ্চাত্য ইতিহাসবিদ সি সি টোরের বক্তব্য থেকেই। তিনি বলেন :
‘All the properties of the Quranic diction including the foreign words and proper names, had been familiar in Mekka before [Muhammad S.W] appeared on the scene.’
অর্থাৎ : “কোরআনিক ভাষার সব উপাদান—বাহ্যিক শব্দ ও বিশেষ নামসমেত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের আগেই মক্কার সমাজে সাধারণভাবে পরিচিত ও ব্যবহৃত ছিল।”
(C.C. Torrey; The Jewish Foundation of Islam, 2nd Lecture : Genesis of the New Faith)
এ বক্তব্য নিজেই প্রমাণ করে যে কোরআনের ভাষা কোনো হঠাৎ আবির্ভূত ভাষা নয়; বরং তা ছিল ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় আরব সমাজে প্রাচীনকাল থেকেই জীবন্ত ও সচল একটি ভাষা, যা স্বাভাবিকভাবে হিব্রু ও অন্যান্য সামি ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে। আর তাই, একে হিব্রু বা অনারবি কোনো ভাষার অনুকরণ বলে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
আল্লাহ তাআলা যখন মানব জাতির প্রতি নিজের বার্তা প্রেরণ করেন, তখন সেই বার্তার বাহক হিসেবে মানবীয় ভাষা ও মানবীয় মাধ্যমকেই গ্রহণ করেন। এ থেকেই এটা কখনোই প্রমাণ হয় না যে সেই বার্তা পূর্ববর্তী কোনো ধর্ম বা পরম্পরা থেকে নকল বা হুবহু ‘আপডেট ভার্সন’ মাত্র।
কোরআন নিজেই ঘোষণা করে এটি পূর্ববর্তী নবীদের বার্তারই ধারাবাহিকতা এবং সত্যিকার দ্বিন সর্বদা এক ও অভিন্ন, যা নূহ (আ.), ইবরাহিম (আ.), মুসা (আ.) ও ঈসা (আ.) সহ সব নবীকেই প্রদান করা হয়েছিল।
ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতি (রহ.) তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ ‘আল-ইতকান’-এ একটি পূর্ণ অধ্যায় (৩৮তম প্রকার) লিপিবদ্ধ করেছেন কোরআনে ব্যবহৃত অনারবি শব্দ নিয়ে। সেখানে তিনি প্রায় ১০০ শব্দের উদাহরণ দিয়েছেন, যেগুলোর মূল উৎপত্তি আরবির বাইরে। অন্যদিকে ইমাম শাফি (রহ.), আবু উবাইদাহ (রহ.) এবং ইবনু আওস (রহ.) প্রমুখ উলামায়ে কেরাম কোরআনে অনারবি শব্দ ব্যবহারের ধারণা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
প্রখ্যাত তাফসিরবিদ ইবনু জারির (রহ.) বলেন, এ জাতীয় শব্দসমূহ আরবি ও অন্যান্য ভাষায় সমসাময়িকভাবে প্রবেশ করেছে—যাকে ‘তাওয়ারিদ’ বলা হয় অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত মিল। বেশির ভাগ আলিম ও মুফাসসিরের মতে, এসব শব্দ দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে আরবি ভাষায় পুরোপুরি মিশে গিয়েছিল। আরবদের দৈনন্দিন ভাষাচর্চা, কবিতা ও সাহিত্যে এত বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল যে, এ শব্দগুলো তখন আরবিরই অংশে পরিণত হয়েছিল।
সুতরাং, ভাষার পারস্পরিক আদান-প্রদান কোনো ধর্মগ্রন্থের মৌলিকত্ব বা ঐশী উৎসর ওপর আঘাত করে না; বরং তা ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তন ও মানব সভ্যতার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনেরই নিদর্শন।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন